ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বহু বিপ্লবীর নাম লেখা রয়েছে রক্তে ও অক্ষয় সাহসে। কিন্তু সেই তালিকায় এক বিস্মৃত, তবু এক অবিনশ্বর নাম— দুকড়িবালা দেবী। তাঁর জীবন একাধারে সাহস, আত্মত্যাগ, আর নারী-শক্তির এক অমর প্রতীক।
২১শে জুলাই ১৮৮৭ সালে, বীরভূম জেলার নলহাটি থানার অন্তর্গত ঝাউপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন দুকড়িবালা দেবী। পিতা নীলমণি চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা কমলকামিনী দেবীর কন্যা দুকড়িবালা ছোট থেকেই ছিলেন সাহসী ও চিন্তাশীল। ঝাউপাড়াতেই তাঁর বিয়ে হয় ফণীভূষণ চক্রবর্তীর সঙ্গে।
দুকড়িবালা দেবীর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেন তাঁর বোনপো, বিপ্লবী নিবারণ ঘটক। এই নিবারণ তাঁর কাছে শুধু একজন প্রিয় আত্মীয় ছিলেন না, বরং এক বিপ্লবের দূত। তাঁর বন্ধুবান্ধব, গোপন স্বদেশী বই, আর বেআইনি কার্যকলাপের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল দুকড়িবালারই ঘর।
সেই ঘরের আড়ালে বসেই তিনি পড়তে শুরু করলেন সেই সব বই, যেগুলো নিষিদ্ধ ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনে। যতই পড়লেন, ততই যেন হৃদয়ে আগুন জ্বলে উঠল।
একদিন বোনপো নিবারণের বিয়ের প্রসঙ্গে দু’জনের মধ্যে তুমুল তর্ক বাঁধে। শর্ত হয়—তর্কে যে হারবে, সে বিজয়ীর পথ গ্রহণ করবে। মাসিমা দুকড়িবালা হেরে যান। কিন্তু হার মানেন না, বলে ওঠেন— “এবার আমায় দলে নিয়ে নাও।” নিবারণ বলেন, “তুমি কি এ পথে চলতে পারবে, মাসিমা?” তখনই গর্জে উঠে দুকড়িবালা বলেন— “তুমি যদি দেশের জন্য প্রাণ দিতে পার, তবে তোমার মাও পারে!”
এরপর থেকেই দুকড়িবালা দেবী হয়ে ওঠেন 'মাসিমা' নামেই পরিচিত এক বিপ্লবী চরিত্র। তিনি শুধু মনেই বিপ্লবী ছিলেন না, হাতে তুলে নেন অস্ত্রও।
১৯১৪ সালে বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে— রডা কোম্পানির মাউজার পিস্তল ও কার্তুজ লুট। এই অপারেশনে বিপ্লবীরা খালাসের সময় এক গরুর গাড়ির চালক হিসেবে ছদ্মবেশে বিপ্লবী হরিদাস দত্ত-কে পাঠান। রডা কোম্পানির মাল খালাসের সময় সাতটি গাড়িতে করে ২০২টি বাক্স স্থানান্তর করা হচ্ছিল। ছয়টি পৌঁছে যায় গন্তব্যে, কিন্তু একটি গাড়ি উধাও হয়ে যায়।
এই গাড়ির নয়টি বাক্সে ছিল কার্তুজ আর একটিতে ছিল ৫০টি মাউজার পিস্তল। এগুলি ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন বিপ্লবী কেন্দ্রে। এর একটি অংশ আসে নিবারণ ঘটকের কাছে—আর তারই সাতখানি মাউজার পিস্তল ও কার্তুজ নিজের হেফাজতে রেখে দেন দুকড়িবালা দেবী।
কিন্তু ব্রিটিশ সরকার থেমে ছিল না। ৮ই জানুয়ারি ১৯১৭—দুকড়িবালা দেবীর বাড়িতে পুলিশের তল্লাশি শুরু হয়। পাওয়া যায় সাতটি মাউজার পিস্তল। তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়। শত চেষ্টাতেও পুলিশ তাঁর মুখ থেকে একটি শব্দও বের করতে পারেনি—তিনি কোন বিপ্লবীর কাছ থেকে অস্ত্র পেয়েছেন, তা তিনি আজীবন গোপন রাখেন।
শুধু ভাবুন—একজন মা, একজন গ্রামের বউ, তাঁর কোলের শিশু রেখে নিজের হাতে তুলে নেন শিকল! কাঁদেন না, দুঃখ করেন না। সেই মুহূর্তে দুকড়িবালা আর একজন সাধারণ নারী নন—তিনি এক অগ্নিকন্যা।
বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। অন্যদিকে, নিবারণ ঘটকের হয় পাঁচ বছরের কারাবাস।
কারাগারে দুকড়িবালার জীবন ছিল আরও নির্মম। প্রতিদিন তাঁকে আধমন ডাল ভাঙতে হতো। তবুও বাবাকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন:
“আমি ভালো আছি, আমার জন্য কেউ চিন্তা করো না। শুধু বাচ্চাদের দেখো, তারা যেন না কাঁদে।”
১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে কারাগার থেকে মুক্তি পান এই নারী সৈনিক। এরপর দীর্ঘ জীবন নিঃশব্দে কাটিয়েছেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম রয়ে গেছে উজ্জ্বল অক্ষরে।
অবশেষে ২৮শে এপ্রিল ১৯৭০ সালে, তিনি পাড়ি দেন চিরতরে।
দুকড়িবালা দেবী ছিলেন সেইসব নারীর প্রতীক, যাঁরা নিজেদের পরিচয় ভুলে দেশের জন্য সব কিছু ত্যাগ করেছিলেন। তিনি শুধু একজন বিপ্লবী ছিলেন না—তিনি ছিলেন 'মাসিমা', যাঁর সাহসে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মাথা উঁচু করে বলতে পারে— আমাদের স্বাধীনতা এমনি এমনি আসেনি, একেকটি জীবনের আগুনে পুড়ে এসেছিল।
লেখক: প্রকাশ রায়
তথ্যসূত্র::- স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, কমলা দাশগুপ্ত


0 মন্তব্যসমূহ