বীণা দাস: পাটের শাড়িতে মোড়া এক বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি

১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে হাজার হাজার চোখের সামনে ঘটে গেল এক যুগান্তকারী ঘটনা। একটি অতি সাধারণ পাটের শাড়ি পরিহিতা মেয়ে—তাঁর চোখে আগুন, মনে বিদ্রোহ, হাতে পিস্তল। সেই ছাত্রীটি ছিল বীণা দাস। যিনি সাহস করে তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন—কলকাতার অভিজাত সোসাইটির বুকে ঘটেছিল সেই বিস্ফোরণ। ইতিহাস আজও সেই শব্দে কেঁপে ওঠে।


বীণা জন্মেছিলেন ১৯১১ সালের ২৪ আগস্ট, কৃষ্ণনগরে। পরিবারে দেশপ্রেম ছিল যেন রক্তে মিশে থাকা উপাদান। পিতা বেণীমাধব দাস ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের শিক্ষক ও চিন্তাবিদ, মা সরলা দেবী সমাজসেবিকা। বোন কল্যাণী দাস ছিলেন 'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন'–এর অন্যতম সংগঠক। সুতরাং, বীণার কাছে দেশপ্রেম ছিল শুধুই পাঠ্য বিষয় নয়—জীবনের মন্ত্র।
বেথুন কলেজে পড়াকালীন তাঁর রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। তিনি অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স ও ছাত্রী সংঘে যুক্ত হন এবং ধীরে ধীরে সমাজসেবার পথ থেকে গোপন বিপ্লবী কাজে জড়িয়ে পড়েন। তখন দেশ জ্বলছে ব্রিটিশ দমন-পীড়নে, আর তরুণ প্রজন্ম খুঁজছে সশস্ত্র প্রতিবাদের ভাষা।
গভর্নরকে গুলি চালানোর পর গ্রেপ্তার হন বীণা। আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন,
"আমি জানি আমার কাজের পরিণাম। কিন্তু আমি দেশকে ভালোবেসে এই পথবেছে নিয়েছি।" এই উচ্চারণ তাঁকে শুধু বিপ্লবী নয়, এক জীবন্ত দর্শনের প্রতীক করে তোলে। আদালত তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়, যা তিনি মেনে নেন মাথা উঁচু করে।
কারাবাস থেকে মুক্তির পর তিনি গান্ধীজির আদর্শে প্রভাবিত হয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের বিত্তবান রাজনীতির জগতে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি। পদ্মশ্রী সম্মানও গ্রহণ করেননি তিনি। নিজের কথা লিখেছেন আত্মজীবনী ‘শৃঙ্খল ঝংকার’-এ, যেখানে স্বাধীনতার স্বপ্ন ও বাস্তবতার সংঘাত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বীণা দাসের মৃত্যু ঘটে ১৯৮৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর, রিশিকেশে। মৃত্যুর বহুদিন পরে তাঁর দেহ শনাক্ত হয়। সেই নিঃসঙ্গ মৃত্যু যেন আরও একবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বিপ্লবীরা শুধু যুদ্ধ করে না, ইতিহাসের অন্ধকারেও নিঃশব্দে হারিয়ে যেতে পারেন।
তবুও, ইতিহাস ভুলে গেলেও কিছু মুখ বারবার ফিরে আসে। পাটের শাড়ি পরা, দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটি আজও ভারতবর্ষের সাহসের এক অনন্য প্রতিমূর্তি।

লেখায়: প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ