ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এমন বহু নাম আছে, যারা প্রচারের আলোয় খুব বেশি আসেননি, তবু তাঁদের রক্ত, ত্যাগ, ও দৃঢ় মনোবল আজও এই মাটির বুকে প্রতিধ্বনি তোলে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম এক নাম — অমর বিপ্লবী রামকৃষ্ণ খত্রী, যিনি জীবনভর দেশপ্রেম, সাহস, আর আদর্শকে অবলম্বন করে ছিলেন নির্ভীক পথিকের মতো।
রামকৃষ্ণ খত্রীর জন্ম ১৯০২ সালের ৩ মার্চ, মহারাষ্ট্রের বুলঢানা জেলার চিখলি নামক ছোট্ট গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন শিবলাল চোপড়া এবং মাতা কৃশ্নাবাই, যাঁদের আদর্শ ও সংস্কার তাঁকে শৈশব থেকেই দেশপ্রেমের আবহে বড় করে তোলে। এক সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও খত্রী ছিলেন অসাধারণ মনের মানুষ। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি তিলকের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতির ও সমাজচেতনার জগতে প্রবেশ করেন। তাঁর নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে এক ছোট সংগঠন — “উদাসীন মণ্ডল”, যা ছিল দেশের স্বার্থে যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার এক প্রাথমিক প্রচেষ্টা। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারেন যে স্বাধীনতা কেবল রাজনীতির বিষয় নয়, এটি সমাজজাগরণের এক বিশাল আন্দোলন।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রামকৃষ্ণ খত্রীর মন ভরে ওঠে বিপ্লবের আগুনে। তিনি যোগ দেন সেই সময়ের অন্যতম গোপন বিপ্লবী সংগঠন হিন্দুস্তান প্রজাতন্ত্র সংঘ (Hindustan Republican Association)–এ, যার নেতৃত্বে ছিলেন রামপ্রসাদ বিসমিল, অশফাকুল্লাহ খান, রোশন সিং প্রমুখ। মধ্য ভারত ও মহারাষ্ট্রে এই সংগঠনের কাজ বিস্তারে তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস বলে, ১৯২৫ সালের ৯ আগস্ট, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় — কাকোরি কাণ্ড — সংগঠিত হয় ঠিক সেই সংগঠনের উদ্যোগে। ব্রিটিশ সরকারের ট্রেন থেকে বিপ্লবের তহবিল সংগ্রহের জন্য সাহসিকতার সঙ্গে অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ খত্রীও। তাঁর পরিকল্পনা, উপস্থিতি ও নেতৃত্ব সেই ঐতিহাসিক ঘটনার একটি নেপথ্য স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু স্বাধীনতার জন্য যে পথ তিনি বেছে নিয়েছিলেন, তা সহজ ছিল না। কাকোরি কাণ্ডের তদন্তে ব্রিটিশরা বহু বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে, এবং রামকৃষ্ণ খত্রীকেও আটক করা হয়। তাঁকে দেওয়া হয় দশ বছরের কঠোর কারাদণ্ড। কারাগারে নির্যাতনের ভয়াবহতা, শারীরিক কষ্ট এবং নিঃসঙ্গতার মধ্যেও তিনি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি লিখেছিলেন, “আমার শৃঙ্খল কেবল দেহে, মনে নয়; আমার মন আজও মুক্ত ভারতের সূর্য দেখছে।”
দশ বছরের কারাবাস শেষে রামকৃষ্ণ খত্রী ফিরে আসেন সমাজে, কিন্তু বন্দিদশা তাঁর জীবনদর্শনকে বদলাতে পারেনি। বরং তিনি তখন আরও বেশি করে সাধারণ মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বিপ্লবী পরিবারের সহায়তা শুরু করেন, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করেন, এবং দেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সমাজগঠনে অবদান রাখেন। তিনি কেবল অস্ত্রধারী বিপ্লবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভাবধারার বিপ্লবী — যিনি বিশ্বাস করতেন, স্বাধীনতা তখনই পূর্ণ হবে যখন সমাজে শিক্ষার আলো, ঐক্যের শক্তি এবং আত্মসম্মান জাগবে।
এই সময়েই তিনি নিজের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের কাহিনি লিখতে শুরু করেন। তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ “শহীদদের ছায়ায়” (In the Shadow of the Martyrs), যেখানে তিনি শুধু কাকোরি কাণ্ড নয়, বিপ্লবীদের মানসিকতা, দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত এই বইটি আজ ভারতের বিপ্লবী ইতিহাসের একটি মূল্যবান দলিল হিসেবে গণ্য হয়।
স্বাধীনতা অর্জনের পরও রামকৃষ্ণ খত্রী ভুলে যাননি তাঁর সহযোদ্ধাদের ত্যাগ। তিনি উদ্যোগ নেন “কাকোরি শহীদ স্মৃতি” প্রতিষ্ঠার, যেখানে বিপ্লবীদের স্মরণে স্মারক নির্মিত হয়, অনুষ্ঠিত হয় বার্ষিক সভা ও আলোচনাচক্র। তাঁর প্রচেষ্টায় উত্তর প্রদেশের কাকোরিতে আজ যে বিপ্লবী স্মারক দাঁড়িয়ে আছে, সেটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অমর চিহ্ন হয়ে আছে।
বয়স বাড়লেও তাঁর মনের জোয়ার কমেনি। ৯০ পেরিয়েও তিনি নিয়মিত সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, “স্বাধীনতা রক্ষা করা স্বাধীনতা পাওয়ার থেকেও কঠিন।” জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেই বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন। ১৮ অক্টোবর ১৯৯৬ সালে লখনউ শহরে এই মহান বিপ্লবী পরলোকগমন করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।
রামকৃষ্ণ খত্রীর জীবন এক প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের মতো, যা কেবল স্বাধীনতার আগুনেই জ্বলেনি, জ্বালিয়েছে মানবতার, ঐক্যের, আর ন্যায়ের শিখাও। তাঁর নাম আজও ভারতের বিপ্লবী ইতিহাসে অমর হয়ে আছে — “অমর বিপ্লবী রামকৃষ্ণ খত্রী”, এক অকুতোভয় যোদ্ধা, যিনি বুকে ধারণ করেছিলেন একটাই স্বপ্ন — “মা ভারত হোক মুক্ত, আর সন্তানরা হোক সাহসী।”
লেখায়: প্রকাশ রায়


0 মন্তব্যসমূহ