দিনটি ছিল ২১ শে নভেম্বর ১৯৪৫ সাল। শীতের কুয়াশা তখনও পুরোপুরি কাটেনি, অথচ কলকাতার রাস্তায় উত্তাল জনতার ঢেউ। আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে শোভাযাত্রায় নেমেছিলেন হাজারো মানুষ। সেই মিছিলে ছিলেন বাঙালি সমাজের দুর্দান্ত সংগ্রামী নারী—জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলি। পুলিশের আক্রমণে নিহত বিপ্লবী রমেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মরদেহ নিয়ে যখন শোক-শোভাযাত্রা এগোচ্ছিল শ্মশানের পথে, ঠিক তখনই নির্বিকার রাস্তায় হঠাৎ দ্রুতগতির একটি মিলিটারি ট্রাক পেছন দিক থেকে ধাক্কা দেয় জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলিকে। আঘাতে লুটিয়ে পড়েন তিনি—রক্তে ভিজে ওঠে পথের পাথর, মানুষ ছুটে আসে চারদিক থেকে। গুরুতর আহত জ্যোতির্ময়ী কিছু ঘণ্টা পর প্রাণ হারান। স্বাধীনতার দাবিতে রাস্তায় নেমে এভাবেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলার অগ্নিকন্যা—জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলি।

১৮৮৯ সালের ২৫ জানুয়ারি কলকাতায় জন্ম তার। পিতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়—শ্রমিকদরদী, সমাজসেবক, দেশকর্মী। আর মা কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়—বাংলার প্রথম মহিলা স্নাতক, প্রথম চিকিৎসক, সমাজসেবিকা। এমন দেশপ্রেমিক পরিবারে জন্মেই যেন তিনি স্বাধীনতার বীজ বুকে ধারণ করেছিলেন। জ্যোতির্ময়ী ছিলেন অবিবাহিতা—স্বাধীনতার স্বপ্নই ছিল তার জীবনসঙ্গী। তার সহোদর ছিলেন প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়।
নারীশিক্ষা বিস্তারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এমএ পাশ করে তিনি কর্মসূত্রে যুক্ত হন কটকের র্যাভেনশ গার্লস কলেজ, কলম্বো বুদ্ধিস্ট গার্লস কলেজ, পরে কলিকাতা ব্রাহ্ম স্কুলে অধ্যক্ষা হিসেবে। নারীশিক্ষাকে শক্তিশালী স্তম্ভে রূপ দিতে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। লালা লাজপত রায়ের আমন্ত্রণে যোগ দেন জলন্ধর কন্যা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষা হিসেবে—দেশসেবার আরেকটি নতুন ক্ষেত্র খুলে যায় তার সামনে।
নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও দেশসেবায় উদ্বুদ্ধ করতে তিনি গঠন করেন নারী স্বেচ্ছাসেবীকা বাহিনী। তিনি যুক্ত হন ‘বিদ্যাসাগর বানীভবন’-এর কাজেও। নারী-মুক্তি, বিধবাবিবাহ, মাতৃভাষাভিত্তিক আধুনিক শিক্ষাদান—এসব বিষয়ে তার সমর্থন ছিল অদম্য। সমাজ ও রাজনীতির নানা প্রশ্নে লিখতেন ‘প্রবাসী’, ‘মডার্ন রিভিউ’সহ বিভিন্ন পত্রিকায়। অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট পেডির বিরুদ্ধে তার লেখা "Another Crucifixion" ছিল ঝড় তোলা প্রতিবাদের মশাল। বর্ণভেদ ও অস্পৃশ্যতার মতো সামাজিক কুপ্রথারও ছিলেন তিনি তীব্র সমালোচক। হিরণ্ময়ী বিদ্যা শিল্পাশ্রম, পুরী বসন্তকুমারী বিদ্যাশ্রমসহ বহু নারী-কল্যাণ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯২৬ সালে সমাজসেবার উদ্দেশ্যে একটি ছাত্রসংগঠনও গঠন করেন।
পিতামাতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯২০ সালের কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি প্রথম নারী-স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী গঠন করেন, নারীদের প্রকাশ্যে রাজনীতিতে যুক্ত করার আন্দোলনে নেমেছিলেন তিনি। ১৯৩০ সালে চাকরি ছেড়ে সম্পূর্ণভাবে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন, শহর-গ্রাম মিলিয়ে গড়ে তোলেন সংগঠন। একই বছরে লবণ আইন অমান্য করে গঠন করেন ‘নারী সত্যাগ্রহ’। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে দু'বার কারাবরণও করতে হয় তাকে।
১৯৩২ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে তিনি ছিলেন সম্মুখসারির যোদ্ধা। ঊর্মিলা দেবীর নেতৃত্বে গঠিত নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সভাপতি হিসেবেও তিনি ছিলেন নির্ভীক। ১৯৩১ সালের ২৬ জানুয়ারি, ইংরেজ কর্মকর্তা চার্লস টেগার্টের আক্রমণ থেকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি নিজেই আহত হন—অদম্য সাহস, দেশপ্রেম আর ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এই ঘটনা।
শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন সংগ্রামের পথে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, নারীর অধিকার ও দেশের স্বাধীনতার পক্ষে। আর তাই ২১ নভেম্বর ১৯৪৫—শহরের রাস্তায় শেষ লড়াইয়ে নেমে তার জীবন দাঁড়িয়ে পড়ে ইতিহাসের আলোয়।
জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলি—একজন নারীর নাম নয়, এক প্রবল শক্তির নাম। মমতা, সাহস, বেদনা আর দেশপ্রেমে বোনা তার জীবন ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে চিরকাল।
0 মন্তব্যসমূহ