রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়

রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ করে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন—
"মৃত্যুকে তুমি উপহাস করে
করেছো জয়
রক্তস্নানের মধ্যে হয়েছে অরুণোদয়,
প্রাণ সমুদ্রে এনেছো বন্যা কি দুর্জয়।"
কবির এই পংক্তির মতোই এক অবিনশ্বর সাহস, এক নিঃশব্দ আগুনের মতো জ্বলে ওঠা আত্মবলিদানের ইতিহাস যেন জড়িয়ে আছে একটি মাত্র নামের সঙ্গে—রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, এক নামনাজানা অথচ এক বিরল অগ্নিযুগের সশস্ত্র সংগ্রামী।

১৯২৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার বাগড়ায় জন্ম নেওয়া রামেশ্বর—পিতা শৈলেন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাগ্য যেন তাঁকে খুব অল্প বয়সেই ডেকে নেয় ভারতের মুক্তির পথে। তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য ইতিহাসে সংরক্ষিত নেই, কিন্তু যা আছে তা যথেষ্ট তাঁর আগুনের মতো ঝলসে ওঠা ব্যক্তিত্বের কথা জানানোর জন্য। ১৯৪২—দেশ জুড়ে তখন "ভারত ছাড়ো"র দাবিতে আগুনের ঝড়। রেললাইন কাঁপে, কারাগারের প্রাচীর কাঁপে, পুলিশের লাঠির আঘাতে কেঁপে ওঠে ছাত্র-যুবকদের বুক, তবু ভয় নেই কারও চোখে। এই উত্তাল সময়েই রামেশ্বর ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতার আন্দোলনে—অস্ত্রহীন, তবু বুকভরা আগুন নিয়ে।

এরপর আসে ১৯৪৫। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকদের গ্রেপ্তার দেশের বিবেককে আর স্থির থাকতে দেয় না। যুবসমাজ রাস্তায় নামে—কলকাতার আকাশে শোনা যায় বজ্রধ্বনির মতো স্লোগান, “আজাদ হিন্দ ফৌজকে মুক্তি দাও!” সেই ঐতিহাসিক ২১ নভেম্বরের দিনটি সন্ধ্যে ছয়টার ঘন্টা বাজতেই শহর যেন আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ে। শোভাযাত্রায় ছিলেন রামেশ্বর—নির্ভীক, গর্বিত, উত্তাল মানুষের ভিড়ে এক টুকরো জ্বলন্ত প্রতিজ্ঞা হয়ে।

পুলিশ যখন গুলির নির্দেশ পেল, তখন আর কেবল শব্দ নয়—বুকের ভেতরেও যেন বজ্রপাত। একের পর এক গুলি ছুটে এল, আর তার মধ্যেই একটি গুলি বিদীর্ণ করে দিল তরুণ রামেশ্বরের দেহ। ধর্মতলার রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন ছাত্র রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শ্রমজীবী নওজোয়ান আবদুস সালাম। রক্তমাখা ফুটপাতে নিথর হয়ে থাকা দুই তরুণ যেন সেদিন শহরের বুকেই লিখে দিয়েছিল স্বাধীনতার দাম—প্রাণ, রক্ত, আত্মত্যাগ।

সেদিন আহত হয়েছিলেন আরও ৫২ জন। কিন্তু রামেশ্বরের নিথর দেহ নিয়ে যখন শহর উত্তাল হয়ে উঠল, তখন ধর্মতলার বাতাস কাঁপিয়ে একটাই স্লোগান ধ্বনিত হচ্ছিল— “দিল্লি চলো! লাল কিল্লা তোর দো! রামেশ্বর ব্যানার্জী জিন্দাবাদ!”

কলকাতার সেই বিশাল শোক-মিছিলে কোন কান্না ছিল না—ছিল আগুন, ছিল শপথ। মানুষের চোখের জল রামেশ্বরের রক্তের সঙ্গে মিলেমিশে হয়েছিল এক অদম্য প্রতিজ্ঞায়—এই মৃত্যু বৃথা যাবে না। স্বাধীনতার ইতিহাসে হয়তো তাঁর নাম সবার মুখে নেই, কিন্তু তাঁর মৃত্যু ভারতের স্বাধীনতার মাটিকে আরও উর্বর করে গেছে, আরও দৃঢ় করেছে মানুষের লড়াই।

রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়—তুমি সত্যিই মৃত্যুকে উপহাস করেছিলে। তাই আজও, এত বছর পরেও, তোমার নাম উচ্চারণ করলে বুকের ভেতর একটা তীব্র হাওয়া বয়ে যায়… আর চোখের কোণে নেমে আসে নীরব, গর্বমাখা দু’ফোঁটা জল।

— লেখায় : প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ