উজ্জ্বলা মজুমদার

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কত শত নারী তাঁদের সাহস, বুদ্ধি, ত্যাগ আর দৃঢ়তার আলোয় ইতিহাসকে আলোকিত করেছেন, অথচ তাঁদের নাম আজও অজানার অন্ধকারে চাপা পড়ে আছে। এমনই এক বিস্ময়কর নারী, এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, একজন স্নিগ্ধ অথচ অগ্নিময় আত্মার কথা আজ বলতে হবে—ঢাকার জমিদার পরিবারে ২১শে নভেম্বর ১৯১৪ সালে জন্ম নেওয়া এক অসাধারণ কন্যা, যার পিতা ছিলেন সুরেশচন্দ্র মজুমদার। ছোটবেলায় ঘোমটার আড়ালে বড় হওয়া সেই কচি মেয়েটিই পরে কোমরে লুকিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করেন, সহযোদ্ধাদের রক্ষা করেন, আর বারবার জীবন বাজি রেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান—তিনি আমাদের ইতিহাসের এক বিরল দৃষ্টান্ত, উজ্জ্বলা মজুমদার

মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে যেখানে সাধারণ শিশু খেলাধুলা আর পাঠশালার সীমানায় আটকে থাকে, সেখানে উজ্জ্বলা মজুমদার নিঃশব্দে জড়িয়ে পড়েন গোপন সশস্ত্র বিপ্লবী দলে। বিপ্লবীরা কলকাতা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিতেন, তাঁর হাতেই অস্ত্র পৌঁছে যেত নির্দিষ্ট স্থানে। কোমরের কাছে কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে দেওয়া বন্দুক—আর সেই কোমল মুখে দৃঢ়তা ও নির্ভীকতার দীপ্তি, যা প্রতিটি বিপ্লবীর মনেই জন্ম দিত অটল আস্থা। সুকুমার ঘোষ ও মনোরঞ্জন ব্যানার্জী ছিলেন তাঁর গৃহশিক্ষক—কিন্তু পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি তাঁরা তাঁকে শেখাতেন সাহসের পাঠ, স্বাধীনতার মন্ত্র।
গ্রামে থাকার কারণে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় অনেক দেরিতে। বিশ বছর বয়সে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন, তবুও জ্ঞানের প্রতি, সংগ্রামের প্রতি তাঁর তৃষ্ণায় কোনো কমতি ছিল না। তরুণী হওয়ার আগেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলে—আর সেই দলের সঙ্গেই একদিন দার্জিলিং অভিযানে অংশ নিতে যাত্রা করেন। বেড়াতে যাওয়ার অজুহাতে তিনি দার্জিলিং পৌঁছান ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য, সুকুমার ঘোষ, রবি ব্যানার্জীসহ আরও কয়েকজন বিপ্লবীর সঙ্গে। গভর্নর অ্যান্ডারসনকে হত্যা করার পরিকল্পনায় তিনি হয়ে ওঠেন এক অপরিহার্য অংশ। হারমোনিয়ামের ভেতরে লুকিয়ে নিয়ে যান প্রয়োজনীয় মারণাস্ত্র—একদিকে নারীত্বের ছদ্মবেশ, অন্যদিকে অগ্নিকন্যার সংকল্প।
দার্জিলিংয়ে একটি হোটেলে তিনি থাকেন মনোরঞ্জন ব্যানার্জীর সঙ্গে—স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে। ৮ মে ১৯৩৪—ইতিহাসের এক সাহসিক দিনের ভোর। লেবং রেসকোর্সের মাঠে বিপ্লবী ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য গভর্নরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। গভর্নর অল্পের জন্য বেঁচে যান, ভবানী ধরা পড়েন—পরবর্তীতে তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। উজ্জ্বলা ও মনোরঞ্জন ছদ্মবেশে কলকাতায় পালিয়ে আসেন এবং আশ্রয় নেন বিপ্লবী শোভারানি দত্তের বাড়িতে।
কিন্তু স্বাধীনতার পথ কখনও সহজ হয় না। ১৮ই মে শোভারানি দত্তের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ এবং উজ্জ্বলাসহ সবাই গ্রেপ্তার হন। স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে কঠিন বন্দীজীবন কাটাতে হয় তাঁকে। পরে মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা জেল থেকে মুক্তি পান তিনি।
মুক্তি পেলেও সংগ্রাম শেষ হয়নি। তিনি আবার যোগ দেন স্বাধীনতার লড়াইয়ে—১৯৪২ সালের “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনে অংশ নিয়ে আবারও কারাবরণ করেন। চার বছর প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি থাকার পর ১৯৪৬ সালে মুক্তি পান। জেলের ভেতরে বসেই তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং বি.এ পাশ করেন—অদম্য ইচ্ছাশক্তির এক স্বাক্ষর।
স্বাধীনতার পরে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনে। এরপর সমাজসেবা হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান কাজ। নোয়াখালির দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় তাঁর ত্রাণসেবার ভূমিকা ছিল অনন্য। বারাসাতের কাছে অনুন্নত শ্রেণীর উন্নতির জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘পল্লী নিকেতন’—যা ছিল তাঁর স্বপ্ন, তাঁর সৃষ্টির একটি বড় নিদর্শন। রাজারহাট থানার বেশ কিছু গ্রামে তিনি মানুষের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।
১৯৪৮ সালে তিনি বিবাহ করেন বিপ্লবী ও সাহিত্যিক ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়কে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি দেশের মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। অবশেষে ২৫ এপ্রিল ১৯৯২ সালে নিভে যায় সেই অগ্নিমানবীর দীপ্ত প্রাণ।
উজ্জ্বলা মজুমদার—যে নাম উচ্চারণ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক সাহসী মেয়ের অবয়ব। কোমলতায় ভরা, অথচ ভিতরে ইস্পাতের মতো দৃঢ়। তিনি জন্মেছিলেন শুধু একটি পরিবারের কন্যা হিসেবে নয়—একটি জাতির ভবিষ্যৎ আলো হিসেবে। অগ্নিযুগের ইতিহাসে তাঁর নাম উজ্জ্বল, দীপ্ত ও চিরস্মরণীয়।
— লেখায় : প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ