কর্তার সিং সারভা

১৬ নভেম্বর ১৯১৫—লাহোর জেলের নিস্তব্ধ ভোর। ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত, ইংরেজ সরকার রায় ঘোষণা করেছে। তখন তার বয়স মাত্র উনিশ পেরিয়েছে একটু—আর তবুও মৃত্যুকে তিনি অভ্যর্থনা করেছিলেন হাসিমুখে, যেন স্বাধীনতার পথে এটাই ছিল তার প্রথম পবিত্র যজ্ঞ। যে তরুণের সাহস, দুঃসাহস আর দেশপ্রেম পরবর্তীতে সর্দার ভগৎ সিং-এর মতো বীরেরও হৃদয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল আগুন, সেই অগ্নিশিখার নাম—কর্তার সিং সারভা

১৮৯৬ সালের ২৪ মে, লুধিয়ানার সাধারণ এক পরিবারে জন্ম তার। ছোটবেলাতেই পিতা হারান, বড় হন কাকার আশ্রয়ে—একদিকে লুধিয়ানার পাঠ, পরে ওড়িশার পড়াশোনা; কিন্তু পড়ার খাতার ওপরে কোথায় যেন ঠিকরে উঠছিল অন্য বিদ্যা—দেশমাতৃকার দুর্দশা, জাতির আবেগ, স্বাধীনতার আখাঙ্কা। ১৯১২ সালে তাকে পাঠানো হলো আমেরিকায়, আর সেই যাত্রাই বদলে দিল তার ভবিষ্যৎ। ভারতের দুঃখ-কষ্ট তিনি জানতেন—কিন্তু আমেরিকায় গিয়ে প্রথম বুঝলেন দেশের মানুষের প্রকৃত যন্ত্রণা কত গভীর, কত অসহ্য।
সেই ১৯১২ সালেই আমেরিকায় অনুষ্ঠিত হয় বড় ভারতীয় সম্মেলন—সেখানে সোহন সিং ভকনা, হরনাম সিংদের মতন সংগ্রামীদের ভাষণে তার হৃদয় রক্তগরম হয়ে ওঠে। একই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন তিনি। কিন্তু আসল পরিবর্তন আসে যখন লালা হরদয়াল তার জীবনে প্রবেশ করেন। হরদয়ালের বিপ্লবী আহ্বান যেন বজ্রের মতো আঘাত করে হৃদয়ে—দেশকে মুক্ত করার সংকল্প তখনই জন্ম নেয়, আর তার পরেই কর্তার সিং দাঁড়িয়ে যান গদর আন্দোলনের দরজায়।
১৯১৩ সালে গদর আন্দোলনের সূচনা, ২১ এপ্রিল গদর পার্টির আধিকারিক প্রতিষ্ঠা। নবীন কর্তার সিং সেখানে শুধু সদস্য নন—এক সময় পুরো দায়িত্বই এসে পড়ে তার কাঁধে। তিনি জানতেন, ব্রিটিশ শাসন না ভাঙলে ভারতীয়দের সম্মান কেবল লাঞ্ছিতই হবে। তাই তিনি লোক জড়ো করেন, তরুণদের জাগিয়ে তোলেন, আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করেন। তার দিকে তাকিয়ে হাজারো তরুণ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে স্বাধীনতার।
১৯১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সারা ভারত জুড়ে বিপ্লব ছড়ানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু একের পর এক বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সেই খবর পৌঁছে গেল ইংরেজদের কানে। তারিখ বদলালেও বিশ্বাসঘাতকরা আবার খবর ফাঁস করে দিল। শুরু হলো গ্রেপ্তার। কর্তার সিং ও তার সাথীরা ধরা পড়লেন। রাজদ্রোহের মামলা দায়ের হলো। গদর ও অন্যান্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তখন তিন শতাধিক মানুষ কালাপানির সাজা পেল—স্বাধীনতার স্বপ্নের জন্য এই ছিল তাদের মূল্য।
মাত্র দু-তিন বছরের মধ্যেই কর্তার সিং তরুণদের হৃদয়ে দেশভক্তির লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। গ্রেপ্তার হয়ে কোর্টে দাঁড়িয়ে তাকে যখন শেষ কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো, তিনি শান্ত স্বরে বলেছিলে্রিদ “আমায় কী সাজা দেবেন? যাবজ্জীবন, না ফাঁসি? আমি চাই আমাকে ফাঁসি দিন। যেন এই জন্মভূমিতে আবার ফিরে আসতে পারি। যতদিন না ভারত স্বাধীন হচ্ছে, ততবার যেন জন্ম নিই—এই আমার শেষ ইচ্ছা।” তার কণ্ঠে ছিল অদম্য শ্রদ্ধা, অকৃত্রিম ভালোবাসা—দেশমাতার প্রতি এক চিরন্তন অঙ্গীকার।
ফাঁসির রায় ঘোষণার পর একদিন ঠাকুরদা জেলে দেখা করতে এসে বললেন, “বেটা, আত্মীয়রা তোকে বোকা বলছে। এ সব করার প্রয়োজন কী ছিল? কী অভাব ছিল তোর?” হাসিমুখে কর্তার সিং জবাব দিলেন— “এ রকম খুশি আমি আর কোথায় পাব? কারণ আমাকে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে।” ঠাকুরদা স্তব্ধ হয়ে ফিরে গেলেন। কর্তার সিং সেই থেকে আনন্দে আরও বেশি খাবার চাইতেন—কারণ তিনি জানতেন, মুক্তির মহান যাত্রা এখন একেবারে হাতের কাছে।
১৬ নভেম্বর ১৯১৫। লাহোর জেলে ফাঁসির কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়ালেন কর্তার সিং সারভা। চোখে কোনো ভয় নেই, শুধু দীপ্ত এক আলো—স্বাধীনতার তীব্র বাসনা। সেই সকালে তিনি ফাঁসি পেলেন, কিন্তু জন্ম নিলেন ইতিহাসে—এক অমর অগ্নিশিখা হয়ে।
— লেখায় : প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ