বিষ্ণু গণেশ পিংলে

দেশের স্বাধীনতার প্রভাত তখনো দূরে। আকাশে জমাট অন্ধকার—ব্রিটিশ শাসনের দমবন্ধ করা নিপীড়ন। তবু সেই অন্ধকার ভেদ করে কিছু মানুষ আলোকের পথ দেখাতে এগিয়ে এসেছিলেন—অবিচল, নির্ভীক, আত্মবলিদানে অটল। ঠিক এমনই এক অগ্নিশিখা ১৮৮৮ সালের ২ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের পুনে জেলার এক ব্রাহ্মণ মারাঠি পরিবারে জন্ম নিলেন। শৈশব থেকেই মনের মধ্যে জেগে উঠেছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস, নিষ্পেষিত দেশকে মুক্ত করার তীব্র তাগিদ। শিক্ষার পথে হাঁটতে হাঁটতেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল বিপ্লবের নতুন হাওয়া—আর সেই হাওয়াতেই দীপ্ত হয়ে উঠল এক ভবিষ্যৎ বিপ্লবীর নাম, বিষ্ণু গণেশ পিংলে

বিদ্যালয়ের সঞ্চালক ও সহপাঠীদের মাধ্যমে রাজনীতির আলোচনায় তিনি যেমন উদ্বুদ্ধ হন, তেমনই ধীরে ধীরে তার মনে পুঞ্জীভূত হতে থাকে স্বাধীনতার স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নই একসময় স্কুল বন্ধ হওয়ার পর ১৯১১ সালে তাকে ঠেলে দেয় দূর দেশের পথে—আমেরিকায়। নিজের মাটিকে মুক্ত করার সংকল্প তখন তার রক্তে আগুনের মতো জ্বলছে। দেশ থেকে বিদায় নেওয়ার প্রতিটি ধাপে তিনি মনে মনে উচ্চারণ করেছিলেন—বিপ্লবই মুক্তির একমাত্র পথ।
আমেরিকায় পৌঁছে তার সাক্ষাৎ হয় লালা হরদয়ালের মতো মহামানবের সঙ্গে। বিদ্রোহের আগুন সেখানে আরও দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। লালা হরদয়ালের প্রেরণায় বিষ্ণু গণেশ পিংলে যোগ দেন গদর পার্টিতে। একই সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হন, আর বিপ্লবী দলের প্রধান দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নেন। রক্তের ভেতর তখন শুধু একটাই সুর বাজে—দেশকে মুক্ত করতে হবে, শৃঙ্খল ভাঙতেই হবে।
বিদেশে বসে প্রস্তুতি নিয়ে তিনি ও তার সাথীরা ঠিক করেন ভারতীয় সৈনিকদের বিপ্লবের পথে সংগঠিত করবেন। “কামাগাটা মারু” নামের জাহাজে চেপে তারা দেশে ফিরে আসেন। পিংলে নাম পাল্টে গোপনে ছুটে যান দেশের বিভিন্ন ছাউনিতে। সৈনিকদের কাছে পৌঁছে দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন—“উঠে দাঁড়াও, স্বাধীনতার ডাক এসেছে।” শব্দে শব্দে তিনি যেন আগুন ছড়িয়ে দিতেন, আর সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল সেনার মনে, জনতার মনে।
কিন্তু ইতিহাসের পথচলায় বিশ্বাসঘাতকতার ছায়াও থাকে। ঠিক যখন বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছিল, তখনই এক বিশ্বাসঘাতকের খবরদারিতে ১৯১৫ সালের ২৩ মার্চ মীরাট ক্যান্টনমেন্টে পিংলে ও তার সাথীরা ধরা পড়েন—বোমা, পিস্তলসহ। একসঙ্গে গ্রেফতার হয় ৮২ জন। শুরু হয় ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র মামলা—ভারতকে দাসত্বে বেঁধে রাখতে যে মামলার রায় আগেই নিধারিত ছিল।
বিচারে বিষ্ণু গণেশ পিংলেসহ ২৩ জনের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। পরে ১৭ জনের সাজা কমে যাবজ্জীবনে দাঁড়ালেও পিংলের মতো ছয়জন বীরকে রেহাই দেওয়া হয়নি। দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নে যারা জীবন বিসর্জনে প্রস্তুত ছিলেন, তাদের ফাঁসি দেওয়ার দিন ঠিক হলো—১৯১৫ সালের ১৬ নভেম্বর। লাহোর সেন্ট্রাল জেলের সেই প্রভাতে ফাঁসির দড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পিংলে হাসলেন—কারণ জানতেন, মৃত্যু নয়, এ এক জয়যাত্রা—স্বাধীনতার সূর্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এক পদক্ষেপ।
এইভাবে ফাঁসির মঞ্চে অমর হয়ে রইলেন আরও এক বিপ্লবী, যিনি জীবনের বিনিময়ে রেখে গেলেন স্বাধীনতার অগ্নিগাথা।
— লেখায় : প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ