ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে সাহস, আত্মত্যাগ আর সংগ্রামের কত কাহিনী জ্বলজ্বল করে—কত বীরাঙ্গনার নাম আলো করে থাকে ইতিহাসে। কিন্তু ইতিহাস মাঝে মাঝে কিছু দীপ্ত নামকে আড়াল করে রাখে, সেইসব মানুষদের, যারা জাতপাতের গণ্ডিকে চূর্ণ করে অসম সাহসে লড়াই করেছিলেন দেশের জন্য। আওধের উজারিয়া গ্রামের মাটিতে জন্ম নেওয়া এমনই এক অগ্নিকন্যা—উড়া দেবী পাশি।
১৮৩০ সালের ৩০ জুন তাঁর জন্ম, পাশি সম্প্রদায়ের এক সাধারণ পরিবারে। কিন্তু তাঁর রক্তে ছিল অসাধারণ সাহস, অটুট মনোবল। স্বামী মক্কা পাশি ছিলেন আওধের বিশিষ্ট কুস্তিগির ও হযরত মহলের বাহিনীর যোদ্ধা। ঘরে ঘরে তখন ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারের গল্প, মানুষের যন্ত্রণা আর ক্ষোভ, আর সেসব শুনতে শুনতেই উড়া দেবীর হৃদয়ে জন্ম নিল আগুন—নিজের দেশকে রক্ষা করার, নিজের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আগুন।
আওধের বেগম হযরত মহলের কাছে তিনি সরাসরি অনুরোধ জানালেন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য। বেগম তাঁর চোখে দেখলেন এক অদম্য স্পৃহা, দেখলেন নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা। তাই তিনি শুধু অনুমতি দিলেন না, বরং এক নারী বাহিনীর দায়িত্বই তাঁর হাতে তুলে দিলেন। উড়া দেবী তখন আর সাধারণ নারী নন—দেশ মাতার যোদ্ধা, শত নারীকে নিয়ে সংগঠিত এক লড়াইয়ের অগ্রণী।
ব্রিটিশ বাহিনী যখন আওধ আক্রমণ করতে এগিয়ে আসে, তখন উড়া দেবী ও তাঁর স্বামী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু যুদ্ধের নিষ্ঠুরতায় যখন তাঁর স্বামী প্রাণ হারান, তখন উড়া দেবীর বুকের আগুন আরও প্রজ্বলিত হয়। ব্যক্তিগত শোককে তিনি রূপ দিলেন প্রতিশোধের শপথে। দেশকে রক্ষা করার এই যুদ্ধে তিনি নিজেকে উজাড় করে দিলেন।
১৬ নভেম্বর ১৮৫৭—সিকান্দার বাগের সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তিনি তাঁর নারী বাহিনীকে প্রস্তুত করলেন, সাহস দিলেন, নির্দেশ দিলেন। তারপর নিজে গোপনে উঠে গেলেন একটি পিপল গাছে—সেখানে বসে তৈরি করলেন এক অদৃশ্য প্রতিরোধ। ওপর থেকে লক্ষ্যভেদী গুলিতে একের পর এক ব্রিটিশ সৈন্য পড়তে লাগল। কেউ বুঝতেই পারছিল না এই নিখুঁত আঘাত কোথা থেকে আসছে।
অবশেষে এক ব্রিটিশ অফিসারের নজরে আসে—সৈন্যদের দেহে ওপর থেকে নিচে এসেছে গুলি। সন্দেহ হলো, কোনো গাছে লুকিয়ে থাকা স্নাইপারই এই সব করছে। নির্দেশ এল গাছ লক্ষ্য করে গুলি চালানোর। একসময় গাছ থেকে পড়ে গেলেন এক যোদ্ধা—আর তখনই জানা গেল তিনি নারী। তিনি-ই ছিলেন উড়া দেবী পাশি, মৃত্যুর মুখোমুখি হলেও যিনি লড়াই থামাননি।
উইলিয়াম ফোর্বস-মিচেল তাঁর ‘Reminiscences of the Great Mutiny’ বইতে লিখেছেন— “ওই নারীর কাছে ছিল দুটি পুরনো কেভেলরি পিস্তল, তার কোমরে গোঁজা থাকা পিস্তলটিও তখনো লোডেড। তাঁর থলিতেও কিছু গুলি ছিল। তিনি গাছে বসে তৈরি করে রেখেছিলেন তাঁর অবস্থান, আর সেখান থেকেই তিনি বহু ব্রিটিশ সৈন্যকে হত্যা করেছিলেন।”
উড়া দেবীর জীবন কেবল ব্যক্তিগত সাহসিকতার গল্প নয়—এটি এক ঐতিহাসিক প্রমাণ, যে দলিত নারীরাও এই দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে সমান বীরত্ব দেখিয়েছেন, সমান রক্ত ঝরিয়েছেন, সমান আত্মত্যাগ করেছেন। তিনি আজও আমাদের গর্ব, আমাদের প্রেরণা—আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলে থাকা এক অগ্নিকন্যা।
— লেখায় : প্রকাশ রায়


0 মন্তব্যসমূহ