ফাঁসির মঞ্চে দ্বিতীয় বাঙালি বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত

কানাইলাল দত্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। ৩০ আগস্ট ১৮৮৮ সালে তার জন্ম হয়েছিল চন্দননগরে। তার পিতার নাম ছিল চুনিলাল দত্ত। প্রথম জিবনে তিনি মুম্বাইতে থাকতেন। কারন তার পিতা সেখানেই চাকরি করেন। পরে তাকে চন্দননগরের ডুপ্লে বিদ্যামন্দিরে ভর্তি করানো হয়। সেখানেই কানাইলাল দহত্তের জিবনে পরিবর্তন দেখা যায়। তিনি ভারতের ইতিহাস সমন্ধে আগ্রহী হয়ে ওঠেন ও বিভিন্ন লেখকের রচনা পাঠ করেন মন দিয়ে। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করার পর তিনি হুগলি মহসীন কলেজে ভর্তি হন। তখন ভারতবর্ষ জুড়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়লো চন্দননগরে। তারপর কানাইলাল দত্ত বিপ্লব মন্ত্রে দীক্ষিত হলেন যুগান্তর পত্রিকার পরিচালক চারুচন্দ্র রায়ের কাছে। কলকাতার গুপ্ত বিপ্লবী দলের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ স্থাপিত হলো। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কানাইলাল দত্ত ছিলেন নেতাদের অত্যন্ত প্রিয়। তার ওপর যে কোনো গোপন কাজের দায়িত্ব দেওয়া হতো।

কানাইলাল দত্ত রাত জেগে লিফলেট লিখতেন। সকাল বেলা সেই লিফলেট বিলি করেন বিভিন্ন কেন্দ্রে। তিনি জানতেন এই কাজে ধরা পড়ার সম্ভবনা বেশি, তবুও তিনি এই কাজ করতেন। ১৯০৮ সালে মানিকতলা বোমা মামলায় গ্রেপ্তার হন কানাইলাল দত্ত। কারাগারে থেকে শিকল কাটার পরিকল্পনা করেন তিনি। সেখানে অনেক বিপ্লবী বন্ধু ছিল। একবার অসুস্থ্য কানাই চলছেন হাসপাতালের দিকে। সেখানে যেতে যেতে হঠাৎ একটা ফলের পুঁটলি বানিয়ে ফেললেন কানাইলাল। কেউ দেখছে না তো! ঢাকনাটা সরালেন, এ কি? একটা আস্ত আধুনিক রিভলবার। বুঝতে পারলেন, বিপ্লবী বন্ধুরা জেল থেকে পালাবার পরিল্লকল্পনা করছেন। কিন্তু তার কাছে এ খবর দেওয়া হয় নি কেন? এতো বড়ো একটা কাজে কানাইলাল দত্তের কোন ভূমিকা থাকবে না, তাও আবার হয় নাকি? সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বললেন কানাইলাল। সত্যেন বসুও সব কথা খুলে বললেন। সব শুনে কানাইলাল বললেন, আপনাকেও তোমাদের সঙ্গে নিতে হবে।
কানাইলাল দত্তকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ক্ষুদিরাম বসু চলে গেলেন, প্রফুল্ল চাকীও চলে গেলেন। এবার সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পালা, শেষ কাজের দায়িত্ব কানাইলাল দত্ত কে নিতে হবে। কানাই এখন যদি জেদ ধরে বসেন, তাহলে হয়তো তার জীবনেও সংসয় দেখা দেবে। কিন্তু কানাইলাল দত্ত চুপ করে বসে থাকার মানুষ ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত সত্যেনকে রাজি হতেই হলো। সত্যেন জানালেন পয়লা সেপ্টেম্বর মামলার তারিখ, সেদিন নরেন গোঁসাই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিবৃতি দেবেন। নরেনকে সেই সুযোগ। দেওয়া হবে না। কারন নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হয়েছেন। যে করেই হোক নরেনকে শেষ করতেই হবে। কানাইলাল এই খবর শুনে উল্লাসে আত্মহারা। নরেনকে কোথায় পাওয়া যাবে? নরেন উইরোপিয়ান ওয়ার্ডে রয়েছেন। একেবারে জামাই আদরে। প্রহরী হিগিনস রয়েছেন তার পাহারায় এর মধ্যে থেকেই কাজ হাসিল করতে হবে। হাতে অস্ত্র এসে গেছে। সত্যেন্দ্রনাথ একবার নিশ্চিন্ত হয়ে এবারে ফাঁদ পাতলেন। বাকি কাজটুকু যে করেই হোক করতে হবে। শেষ অব্দি সত্যেন্দ্রনাথ নরেন এর কাছে গোপনে খবর পাঠালেন। তিনিও রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়ে গেছেন। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিবৃতি দেবেন।
নরেন খবরটা অপরওয়ালা পুলিস কতৃপক্ষের কাছে জানিয়ে ছিলেন। তারা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর এই আর্জি মঞ্জুর করেন। পুলিসের নির্দেশে নরেন এবার সত্যেন বসুকে ভালো করে শিখিয়ে পুড়িয়ে দেবার দায়িত্ব পেলেন। যাতে সত্যেন ভালো করে সাক্ষী দিতে পারে। নরেন মাঝে মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছে আসতেন ও তার সাথে তার প্রহরী হিজিনস ও লিন্টন নামে দুজন থাকত। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শেষ পর্যন্ত নরেনের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললেন। নরেনের উৎসাহের শেষ নাই। শেষ অব্দি সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো বিপ্লবী যদি রাজসাক্ষী হয় তাহলে আর ভাবনা কিসের। সত্যেন্দ্রনাথ বসু এই দিনটির প্রতিক্ষাতেই ছিলেন। কানাইয়ের সঙ্গে শেষ মুহূর্তের পরামর্শ করে নিলেন। ডিসপেনসারির মধ্যেই এই কাজটা করতে হবে। ঠিক হলো কলাইলাল দত্ত সেখানে পৌঁছে যাবেন দাঁত মাজার অছিলায়। সশস্ত্র অবস্থায় থাকবেন। যথা সময়ে অপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। নরেনকে দেখে কানাইলাল বারান্দায় চলে গেলেন। কান সজাগ রাখলেন ঘরের ভিতর। ঘরের ভিতর কথা হচ্ছে, ঠিক তখনই সত্যেন্দ্রনাথ বসু নরেনকে গুলি চালায়। গুলিটি লাগলো উরুতে গুলিবিদ্ধ, নরেন গোঁসাই আর্তনাদ করে ঘর থেকে ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে ধরার জন্য হিগিনস ছুটে এলেন, সত্যেন্দ্রনাথ এর গুলি এসে হিগিনসকে বিদ্ধ করলো। এই হিগিনস হচ্ছেন নরেন গোঁসাই এর গার্ড। এতে নরেন পালাতে চেষ্টা করে, দেখে ফেলেন কানাইলাল দত্ত তার পশ্চাৎধাবন করলেন। হাসপাতালের গেট পার হয়ে নরেনের কাছাকাছি পৌঁছে কানাইলাল গুলি করতে শুরু করেন। গুলি খেয়ে নরেন স্নানঘরের পাশে নর্দমার মধ্যে হামাগুড়ি খেয়ে পরে গেলেন। আরো এক নরেনের দেহরক্ষী লিন্টন কানাইলালকে ধরতে যান, কানাইলালের গুলিতে লিন্টনের কপালের চামড়া ঝরে যায়। সত্যেন্দ্রনাথ এগিয়ে এলেন, দুজনে শেষ গুলিটি অব্দি নরেনের ওপর বর্ষণ করেন। সব মিলিয়ে তারা ৯টি গুলি চালান। জেলের পাগলা ঘুন্টি বেজে উঠল, সশস্ত্র পুলিস বাহিনী এগিয়ে আসেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও কানাইলাল দত্ত কে বন্দি করেন।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও তার বন্ধু কানাইলাল দত্তের বিচারের পালা। কয়েদির পোশাকে আদালতে হাজির করা হলো তাদের, কানাইলাল পরিষ্কার ভাবে বললেন, আমি মেরেছি নরেনকে। ঘটনাচক্রে সত্যেন হাজির ছিলেন, কিন্তু এই ব্যাপারে তার কোন দোষ নেই। আমি একাই মেরেছি। জজ মিস্টার এফ আরো প্রশ্ন করেন, তুমি রিভলবার কোথায় পেয়েছ? কানাই হেসে জবাব দিলেন, রিভালবার পেয়েছি ক্ষুদিরামের আত্মার কাছ থেকে। বিচারে কানাইলাল দত্তের প্রাণ দণ্ড হলো। জেল খানায় মা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। কানাই তার মাকে বলল, এতদিন তুমি শুধু আমার মা ছিলে। আজ তুমি সারা দেশবাসীর মা হয়ে গেলে। একি কম ভাগ্যের কথা। ১০ নভেম্বর ১৯০৮ সালে ফাঁসির দিন ধার্য হয়েছিল। রাত শেষ হবার আগেই হাসি মুখে ফাঁসির রজ্জু গলায় পড়ে বীরের মৃত্যুবরণ করেন কানাইলাল দত্ত।
লেখায়::- প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ