ফাঁসির পূর্বে কানাইয়ের শেষ কথা

জেলের ঘরে আলো-আঁধারিতে ভাইয়ের মুখটা শেষবারের মতো দেখতে এলেন দাদা আশুতোষ। চারপাশে নীরবতা, কেবল পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি। চোখের কোণে জল টলমল, গলায় থেমে থাকা হাজার কথার ভার। মৃদু কণ্ঠে আশুতোষ বললেন, “তোরা যা করেছিস, তা বাঙালির গর্ব। তোর চশমাটা দে, একটা কিছু তো আমার কাছে রাখি।” শুনে ভাইটি হেসে উঠলেন, সেই চেনা দৃপ্ত হাসি—“দাদা, এখন দিতে পারব না চশমাটা। চোখে হাইপাওয়ার তো! ফাঁসির মঞ্চে যদি হোঁচট খাই, ওরা ভাববে বাঙালির ছেলে মৃত্যুর আগে ভয় পেয়েছে। মৃত্যুর পর নিয়ে নিও।” এই বলেই মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন তিনি, যেন মৃত্যুর দোরগোড়াতেও গর্বের সাথে ঘোষণা দিলেন—আমি কানাইলাল দত্ত, বাঙালির সন্তান।

আইনজীবী তখনও অনুরোধ করছিলেন, “আপিল করুন, কানাইলালবাবু। এখনও হাইকোর্ট আছে, সুপ্রিম কোর্ট আছে, প্রিভি কাউন্সিল আছে…” কিন্তু উত্তরে কানাইলালের চোখে ঝলসে উঠেছিল বিদ্রোহের আগুন—“দেয়ার শ্যাল বি নো অ্যাপিল।” মৃত্যুর মুখেও তাঁর কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তার ঝংকার। পরে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন আবেগভরে, “ওহে, কানাই শিখিয়ে দিয়ে গেল কোথায় শ্যাল ব্যবহার করতে হয়, আর কোথায় উইল।”

১৯০৮ সালের ১০ই নভেম্বর—ফাঁসির মঞ্চে পা রাখলেন তিনি। গলায় দড়ি পড়েছে, তবু মুখে কোনো ভয় নেই। বরং চোখে ঝিলিক, ঠোঁটে অম্লান হাসি। তাঁর শেষ ইচ্ছ —“আমার মৃত্যুর পর দেহ নিয়ে শোক নয়, শোভাযাত্রা করো।” কিন্তু শাসকেরা কি কখনও বুঝেছে বিপ্লবীর হৃদয়? নগরপাল অনুমতি দেননি শোভাযাত্রার, তবুও থামানো গেল না শহরের আবেগ।
আট থেকে আশি, নারী থেকে পুরুষ—সবাই নেমে এলেন পথে। কেউ ফুল হাতে, কেউ চন্দন, কেউ ভগবদ্গীতা বুকের কাছে চেপে ধরে। ছাদ থেকে ঝরে পড়ছে ফুলের বৃষ্টি, আকাশে গর্জে উঠছে “বন্দে মাতরম”। কানাইলালের দেহ ছোঁয়ার জন্য উন্মত্ত জনতার ঢল, চোখে অশ্রু, বুকে আগুন। তাঁর শেষযাত্রা হয়ে উঠল এক জাতির পুনর্জন্মের প্রতীক।
শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো, কিন্তু তাতেও থামল না ভালোবাসার জোয়ার। আগুনে মিশে যাওয়া তাঁর দেহের ছাইভস্ম নিতে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল—যেন সেই ধূলিকণায় লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার আশীর্বাদ।
বাঙালির বুক আজও গর্বে ভরে ওঠে তাঁর নাম শুনে—
বীর বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত, যিনি মৃত্যুকেও পরাজিত করে বেঁচে আছেন আমাদের রক্তে, আমাদের গানে, আমাদের ইতিহাসে।
— লেখায় : প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ