অগ্নিযুগের বিপ্লবী ডা. নারায়ণ রায়

স্বাধীনতার আগুনে পুড়ে যাওয়া সেই অগ্নিযুগে জন্ম নিয়েছিলেন এক নিভৃতপ্রিয় অথচ দৃঢ়চেতা মানুষ—যিনি চিকিৎসক হয়েও রক্তের দাম বুঝতেন শুধু শিরায় নয়, মাতৃভূমির মাটিতেও। মায়ের কোলে জন্ম তাঁর ১৯০০ সালে, কলকাতার বুকেই। পিতা ছিলেন ডা. ক্ষেত্রনাথ রায়। তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী, কোমল হৃদয়ের, অথচ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ়। পড়াশোনা করতে করতে তিনি পৌঁছে যান কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে—সেখানে তাঁর চিকিৎসাশিক্ষা যেমন গভীর হয়, তেমনি আরও গভীর হয় মানুষের মুক্তির জন্য হৃদয়ের টান। চিকিৎসক হওয়ার পাশাপাশি তিনি সমাজসেবক, বিপ্লবী, এবং এক অনমনীয় কমিউনিস্ট আদর্শের ধারক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন—ডা. নারায়ণ রায়।

দেশ তখন ফুটছে প্রতিবাদের আগুনে। ১৯৩০ সালের ২৫শে আগস্ট, কলকাতার আকাশে বোমার গর্জন—চার্লস টেগার্টের গাড়ি লক্ষ্য করে ছোঁড়া হলো মৃত্যুর চুম্বন। অনুজাচরণ সেন সেদিনই ঘটনাস্থলে মারা যান, ধরা পড়ে দীনেশচন্দ্র মজুমদার। শহরজুড়ে শুরু হলো ইংরেজদের তল্লাশি, হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল তারা এই বিদ্রোহের সুত্রধরদের। সেই তল্লাশির জালে ধরা পড়লেন ডা. নারায়ণ রায়, সঙ্গে আরও বহু তরুণ বিপ্লবী—ভূপালচন্দ্র বসু, অদ্বৈত দত্ত, অম্বিকা রায়, শোভারানি দত্ত, কমলা দাশগুপ্ত, সুরেন্দ্র দত্ত, রোহিণী অধিকারী প্রমুখ। সকলেই ছিলেন এক আদর্শে জ্বলন্ত—স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করা।

বিচারে নারায়ণ রায় ও ভূপাল বসু পেলেন ১৫ বছরের দ্বীপান্তর দণ্ড। প্রথমে আলিপুর, তারপর বোম্বের যারবেদা জেলে তাঁকে পাঠানো হয়। একলা সেলে বন্দি থেকেও তাঁর মন থাকত মুক্ত—পড়াশোনা চলত অবিরত, হাতে বই মার্ক্স, মনে লেনিন, আর হৃদয়ে ভারতের মুক্তির স্বপ্ন। পরবর্তীতে তাঁকে পাঠানো হয় আন্দামানের সেলুলার জেলে, যেখানে তিনি গড়ে তোলেন "কমিউনিস্ট সংহতি"—এক নবজাগরণের প্রতীক, যেখানে বন্দিরাও স্বপ্ন দেখত এক সমান সমাজের। তাঁর অনুপ্রেরণায় জেলে গড়ে ওঠে “মার্ক্সিস্ট স্টাডি গ্রুপ”—যেন শৃঙ্খলের মধ্যেও চিন্তার স্বাধীনতার আগুন।

এই মানুষটি শুধুই বিপ্লবী ছিলেন না—তিনি ছিলেন এক মানবিক হৃদয়ের চিকিৎসক, যিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের দেহ সুস্থ করা যেমন কর্তব্য, তেমনি মানুষের আত্মাকে মুক্ত করাও এক ধরণের চিকিৎসা। তাঁর সঙ্গী বিপ্লবীরা যখন একে একে শাস্তি পেলেন—সুরেন্দ্র দত্ত ১২ বছর, রোহিণী ৫ বছর, সতীশ ২ বছর—তখনও নারায়ণ রায় তাঁদের মনোবল জুগিয়েছিলেন, হাসিমুখে বলেছিলেন, “জীবন শেষ নয়, লড়াই চলবেই।”

সেই লড়াইয়ের মানুষ, যিনি সেলুলার জেলের অন্ধকারে আলো জ্বালিয়েছিলেন, যিনি বিপ্লবের ভাষা শিখিয়েছিলেন প্রজন্মকে, তিনি একদিন শান্তভাবে বিদায় নিলেন—১লা নভেম্বর ১৯৭৩। কিন্তু তাঁর নাম আজও ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে, যেন এক প্রদীপের শিখা—ডা. নারায়ণ রায়, এক সত্যিকারের বিপ্লবী, এক মানুষ, যিনি প্রমাণ করেছিলেন—দেশপ্রেম কেবল স্লোগানে নয়, ত্যাগেই ধ্বনিত হয় চিরকাল।

—  লেখায় : প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ