আজও ইতিহাসের ধুলোমাখা পাতায় লুকিয়ে আছে এমন কিছু নাম, যাদের বীরত্বের কাহিনী শুনলে বুক ভরে ওঠে গর্বে, চোখ ভিজে আসে শ্রদ্ধায়। যিনি ৮০তে পেরিয়েও তরবারি হাতে লড়েছেন স্বাধীনতার যুদ্ধে, মৃত্যুর মুখেও যিনি হার মানেননি — তিনি হলেন আমাদের অমর বীর, কুনওয়ার সিং।
১৭৭৭ সালের ১৩ই নভেম্বর বিহারের ভোজপুর জেলার জগদীসপুরে মহারাজা শাহাবজাদা সিং ও মহারাণী পাঁচরতন দেবীর ঘরে জন্ম নেন কুনওয়ার সিং। তিনি ছিলেন উজ্জয়নিয়া রাজপুত বংশের সন্তান। ব্রিটিশ কর্মকর্তা তাঁকে এক লম্বা, বলিষ্ঠ ও দৃঢ়চেতা মানুষ বলে বর্ণনা করেছিলেন — মুখে প্রশস্ত হাসি, চোখে অদম্য আত্মবিশ্বাস। ঘোড়ায় চড়া আর শিকার ছিল তাঁর শখ, কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসাই ছিল তাঁর প্রকৃত নেশা।
১৮২৬ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি জগদীসপুরের রাজা হন। কিছুদিন ভাইদের সঙ্গে জমির বিরোধ থাকলেও পরে মিলেমিশে যান। তিনি গয়া জেলার ধনী জমিদার রাজা ফতেহ নারায়ণ সিংয়ের কন্যাকে বিয়ে করেন, যিনি রাজপুতদের সিসোদিয়া বংশের বংশধর ছিলেন।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ শুরু হলে, মঙ্গল পাণ্ডের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারা দেশে জেগে ওঠে বিপ্লবের আগুন। বিহারের দানাপুর, রামগড়, মিরাট, কানপুর, লখনৌ, দিল্লি — সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে স্বাধীনতার অগ্নিশিখা। এই আগুনে নেতৃত্ব দেন কুনওয়ার সিং, তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি মেকু সিং ও অসংখ্য দেশপ্রেমিক সৈনিক।
২৭শে এপ্রিল ১৮৫৭ সালে ভোজপুরি ও দানাপুরের সৈন্যদের নিয়ে তিনি আরা নগর দখল করেন। ব্রিটিশরা শত চেষ্টায়ও তাঁকে পরাজিত করতে পারেনি। পরে যখন আরাতে ব্রিটিশ আক্রমণ নামে, কুনওয়ার সিং ও তাঁর ভাই অমর সিং বাধ্য হন জগদীসপুর ছেড়ে যেতে। কিন্তু যুদ্ধ থামেনি — আজমগর, বানারস, গাজীপুর, গোরখপুর — সর্বত্রই তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন বিদ্রোহী বাহিনীকে।
একজন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ হোমস্ লিখেছিলেন, “ওই বুড়ো রাজপুত অদ্ভুত বীরত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। যদি তাঁর বয়স কিছুটা কম হতো, তবে ১৮৫৭ সালেই হয়তো ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে হতো।”
২৩শে এপ্রিল ১৮৫৮ সালে জগদীসপুরের যুদ্ধে তিনি আবার ব্রিটিশ সেনাকে পরাজিত করেন। কিন্তু যুদ্ধে গুরুতর আহত হন। গঙ্গা পার হওয়ার সময় ব্রিটিশ সেনারা গুলি চালালে তাঁর হাতে গুলি লাগে। সেই আহত হাত তিনি নিজেই তরবারির এক কোপে কেটে গঙ্গার জলে বিসর্জন দেন — যেন দেশমাতার প্রতি অর্পণ করছেন নিজের অঙ্গ।
তিনদিন পর, ২৬শে এপ্রিল ১৮৫৮ সালে, নিজের দুর্গে ফিরে, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান বীর। তাঁর শেষ মুহূর্তেও চোখে ছিল দীপ্ত শপথ— “দেশ বাঁচুক, মাতৃভূমি স্বাধীন হোক।”
আজও বিহারের বাতাসে ভেসে আসে তাঁর নাম — “বীর কুনওয়ার সিং”, যিনি প্রমাণ করে গেছেন, দেশপ্রেমের আগুন কখনও বয়সে ম্লান হয় না।
সংকলনে: প্রকাশ রায়


0 মন্তব্যসমূহ