ইতিহাসের পাতাগুলো উল্টে দেখলেই চোখে পড়ে কত অজানা নাম, কত হারিয়ে যাওয়া বীরত্বের গল্প। যাদের কথা আজ আর কেউ বলে না, অথচ তাদের রক্তেই রাঙা হয়েছে ভারতের স্বাধীনতার পথ। সেই বিস্মৃত নামগুলোর মধ্যে এক উজ্জ্বল অগ্নিশিখা ছিলেন — শিরীষ কুমার মেহতা। তখন তাঁর বয়স মাত্র ষোলো। ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত কিশোরদেহ পড়ে ছিল মাতৃভূমির বুকের ওপর, চারপাশে কাঁদছিল হাজারো দেশপ্রেমিক হৃদয়।
১৯২৬ সালের ২৮শে ডিসেম্বর, মহারাষ্ট্রের ছোট্ট গ্রাম নন্দুরবারে জন্ম নেন শিরীষ। গুজরাট সীমান্তের সেই নন্দুরবার ছিল এক ব্যবসায়িক শহর, কিন্তু সেই বণিকপাড়ার সন্তান জন্ম থেকেই ছিল আগুনের মতো তেজী। পিতা ছিলেন গুজরাটি ব্যবসায়ী, মা ছিলেন এক সাহসী হৃদয় — যিনি প্রতিদিন সন্তানের কানে শুনিয়ে যেতেন স্বাধীনতার গল্প, দেশপ্রেমের মন্ত্র। সেই মন্ত্রেই ছোট্ট শিরীষ গড়ে উঠেছিলেন অগ্নিশিশু হয়ে।
মাত্র বারো বছর বয়সেই তিনি দাদার সঙ্গে হাতে তুলে নেন তেরঙ্গা পতাকা। জনতার মিছিলে স্লোগান তুলতে তুলতে তাঁর চোখে ফুটে উঠত আগামীর মুক্ত ভারতের স্বপ্ন। তারপর আসে ১৯৪২ — ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বছর। চারদিক জুড়ে “বন্দে মাতরম”, “ভারত মাতা কি জয়” ধ্বনিতে কেঁপে উঠছে আকাশ। ৯ই মার্চ, নন্দুরবারে বিশাল সমাবেশে তেরঙ্গা হাতে নেতৃত্বে ছিলেন সেই কিশোর শিরীষ। মাতৃভূমির প্রতি তাঁর আবেগ ছিল আগুনের মতো — ‘নহি শমসে, নহি শমসে নিশান ভূমি ভারতভূমি!’ বলে সারা শহর কাঁপিয়ে দিচ্ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর।
কিন্তু হঠাৎই ব্রিটিশ অফিসারের নির্দেশে শুরু হল লাঠিচার্জ। শিরীষ পিছু হটলেন না। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মাতৃভূমির প্রতীকে, পতাকা হাতে। একজন ব্রিটিশ অফিসার বন্দুক তাক করতেই শিরীষ চিৎকার করে উঠলেন — “যদি গুলি করতেই চাও, আগে আমাকে মেরো!” আর সেই মুহূর্তে, তেরঙ্গা উঁচু করে ধরে বারবার স্লোগান দিতে লাগলেন — “বন্দে মাতরম! বন্দে মাতরম!” অবশেষে চারটি গুলি এসে বিদ্ধ করল তাঁর বুক। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়লেন তিনি — তবুও পতাকা রইল উঁচু, যেন কিশোর রক্তে ভিজে লাল ভারতের মানচিত্র।
সেদিন শিরীষের সঙ্গে মৃত্যু হয়েছিলেন তাঁর সহযোদ্ধা লাল-লাল ধনসুখ লালওয়ানি, শশীধর কেতকর ও ঘনশ্যাম দাস। কিন্তু ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে গেছেন তারা — রয়ে গেছে শুধু অমর বাণী, “যদি গুলি করতে চাও, আগে আমাকে মেরো!”
আজও যখন তেরঙ্গা উড়ে, বাতাসে কাঁপে সেই সুর — কিশোর শিরীষের অগ্নিবাণী যেন ফিরে আসে, বলতে থাকে — স্বাধীনতার দাম কখনোই সস্তা নয়।
— লেখায় : প্রকাশ রায়


0 মন্তব্যসমূহ