অগ্নির সন্তান: পূর্ণেন্দু শেখর গুহ

রাজবাড়ীর ভবদিয়া গ্রাম — এক নিস্তব্ধ সকাল, ১৯১৪ সালের ১১ নভেম্বর। চিকিৎসক লালবিহারী গুহ ও শতদলবাসিনী দেবীর ঘরে জন্ম নিলেন এক শিশু, যার চোখে যেন তখনই জ্বলে উঠেছিল মুক্তির দীপ। পিতা ছিলেন রংপুরের তাজহাটের জমিদার গোবিন্দলাল রায় বাহাদুরের বন্ধু, আর সেই সম্পর্কের ছায়ায়ই বড় হতে লাগলেন বালকটি। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন জমিদারির নয়, ছিল জাতির মুক্তির। এই মাটির সন্তান পরবর্তীতে হয়ে উঠলেন এক কিংবদন্তি — পূর্ণেন্দু শেখর গুহ।
তাজহাট হাইস্কুলের ছাত্রাবস্থায়ই তিনি স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। মাত্র ১২ বছর বয়সে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা আন্দোলনে। এরপর রংপুর কারমেইল কলেজে ভর্তি হয়ে পড়েন অনুশীলন সমিতির নজরে। যোগ দেন যুগান্তর দলের কর্মকাণ্ডেও। তখনই স্বদেশ মন্ত্রে দীক্ষিত হন, পড়াশোনা ফেলে জীবনটা উৎসর্গ করেন মাতৃভূমির জন্য।

১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নেন নির্ভয়ে। ১৯৩৪ সালে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য কলকাতায় আসেন, কিন্তু পুলিশের হাতে ধরা পড়েন অস্ত্রসহ। ১৪ সেপ্টেম্বর, রংপুর অস্ত্র মামলায় তাঁকে ৯ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। পাঠানো হয় দূর আন্দামানের সেলুলার জেলে — সেই নরকসম দ্বীপে, যেখানে সূর্যও যেন থমকে যায়।

সেখানে থেকেও থামেননি তিনি। ১৯৩৭ সালে ৩৬ দিন অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যান বন্দিদের অধিকারের দাবিতে। তাঁর অনশনে কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। অবশেষে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরোধে তিনি অনশন ভাঙেন, আর সেই সময় জেল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় বন্দিদের দাবিগুলো মেনে নিতে। ১৯৩৮ সালে তাঁকে সেলুলার জেল থেকে আলিপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।

দীর্ঘ বারো বছরের সংগ্রাম শেষে ১৯৪৬ সালে মুক্তি পান তিনি। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রভাতে তিনি আর বিপ্লবী, বন্দি নন — তিনি তখন ইতিহাসের সাক্ষী। জীবিকার তাগিদে যোগ দেন আসাম ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তিনি রয়ে যান সেই আগুনে দেশভক্ত, যিনি নিজের যৌবন দিয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘তাম্রশাসন’ (তাম্রপত্র) দিয়ে সম্মানিত করে। আর ১৯৮২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, নিজের বাড়িতেই চিরবিদায় নেন তিনি — রেখে যান এক নীরব আলোকরেখা, যা এখনো স্মরণ করিয়ে দেয় আত্মত্যাগের মহিমা।

পূর্ণেন্দু শেখর গুহ ছিলেন না কেবল এক বিপ্লবী, তিনি ছিলেন এক জাগরণ — যে আমাদের শেখায়, স্বাধীনতা মানে শুধু শাসকের পতন নয়, স্বদেশপ্রেমের চিরন্তন পুনর্জন্ম।

— লেখায় : প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ