সিপাহী বিদ্রোহ বলতে যে নামটি বজ্রনিনাদে আজও কানে বাজে, যে নাম শুনলেই বুকের ভেতর গর্বে আগুন জ্বলে ওঠে—তিনি ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন নারী খুঁজে পাওয়া কঠিন, যিনি একা হাতে সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বজ্রকঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। অসহায় নয়, ভীত নয়—বরং এক অদম্য, নির্ভীক, আগুনে হৃদয়ের দেশভক্তা ছিলেন তিনি।
১৮২৮ সালের ১৯ নভেম্বর কাশীর পবিত্র ভূমিতে জন্ম নেন মারাঠা ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা মণিকর্ণিকা তাম্বে। পিতা মরুপান্ত তাম্বে ও মাতা ভাগীরথী বাঈ-এর স্নেহে বেড়ে ওঠা এই ছোট মেয়েটির জীবন কিন্তু খুব সহজ ছিল না। মাত্র চার বছর বয়সে মা-কে হারিয়ে তিনি যেন বুঝে গিয়েছিলেন, জীবন লড়াইয়ের নাম। পিতার আদরে, পিতার স্নেহে, ঘরেই শিক্ষা, ঘরেই বেড়ে ওঠা—তাঁকে তিনি ডাকতেন ছাবিলি, কারণ তাঁর চোখে মেয়েটি ছিল হাসিখুশি, চঞ্চল, সাহসভরা আলো।
সময়ের স্রোতে ছাবিলি হয়ে ওঠেন লক্ষ্মীবাঈ—মারাঠা রাজ্যের রাজা গঙ্গাধর রাও-এর সহধর্মিণী। বিবাহের আগের নাম মণিকর্ণিকা বদলে গেলেও বদলায়নি তাঁর অদম্য আত্মা। কিন্তু সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কয়েক বছরের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন রাজা গঙ্গাধর রাও। রাজ্য হয়ে পড়ে বিপন্ন। আর ঠিক সেই সময়ই ব্রিটিশরা ষড়যন্ত্রের জাল ফেলে মারাঠা রাজ্য ছিনিয়ে নিতে চাইছিল। কিন্তু তারা জানত না—এই রাজ্য রক্ষা করবেন এমন এক নারী, যিনি ঝড়ের মতো উঠে দাঁড়াবেন দেশের মর্যাদা রক্ষায়।
১৮৫৭ সালের জুন মাসে ঝাঁসিতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। বিদ্রোহীরা জেল ভেঙে বন্দীদের মুক্ত করে, অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসককে মৃত্যুদণ্ড দেয়—আর সেই বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঝাঁসির রানী। রাজ্যকে মুক্ত করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে গড়ে তুললেন ১৫ হাজারেরও বেশি সৈন্যের বাহিনী। বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে সংগঠিত করলেন সশস্ত্র সংগ্রাম। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপেই ছিল ইস্পাতের দৃঢ়তা, মাতৃভূমির প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা।
১৮৫৮ সালে তিনি অনুরোধ করেন মারাঠা বীর তাঁতিয়া টোপিকে। তিনি ২২ হাজার সৈন্য নিয়ে যোগ দেন ঝাঁসির রানীর বাহিনীতে। একসঙ্গে তারা ব্রিটিশদের শিবিরে আক্রমণ করেন। কিন্তু ২৩ মে, ১৮৫৮—এর যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাপতি হিউরজের কাছে তাঁরা পরাজিত হন। ফলে হাতছাড়া হয় গোয়ালিয়র। নানা সাহেবও সেখানে যুক্ত ছিলেন, তাঁকে পেশোয়া বলে ঘোষণা করা হয়।
এরপর আসে সেই ইতিহাসখ্যাত দিন—১৭ জুন ১৮৫৮। যুদ্ধক্ষেত্র উত্তাল, আকাশ ধূলোয় অন্ধকার। আর মধ্যমণিতে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী—যিনি তলোয়ার তুলে এমন বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, যা দেখে মনে হয় তিনি যেন এক অতিমানবী যোদ্ধা। শত্রুর বুলেট, শত্রুর আক্রমণ—কিছুই থামাতে পারেনি রানীর গতিবেগ। কিন্তু যুদ্ধের মাঝেই আহত হয়ে তিনি লুটিয়ে পড়লেন রণক্ষেত্রে। দেশ রক্ষার জন্য তাঁর শেষ নিশ্বাসটিও ছিল যুদ্ধে, ছিল স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত।
ঝাঁসির মাটি রাঙা হলো তাঁর রক্তে। হাজারো সৈন্য সেই যুদ্ধে প্রাণ দিল। কিন্তু তাঁদের ত্যাগ বৃথা যায়নি—কারণ ইতিহাস সেদিন সোনালি অক্ষরে লিখে নিল নামটি— ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ।
তিনি শুধু একটি চরিত্র নন—তিনি ভারতবাসীর অগ্নি-প্রেরণা, তিনি অবিনশ্বর সাহসের প্রতীক, তিনি স্বাধীনতার সংগ্রামের চিরন্তন শিখা। তাঁর জীবন যেন বলে—“দেশের জন্য বাঁচো, প্রয়োজনে দেশের জন্য প্রাণ দাও। কিন্তু মাথা নত করো না কোনও অন্যায়ের সামনে।”
— লেখায় : প্রকাশ রায়


0 মন্তব্যসমূহ