এক বৃন্তে দুটি কুসুম – হিন্দু মুসলমান

১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা উঠলেই আমাদের মনে পড়ে পন্ডিত মঙ্গল পাণ্ডের নাম। কিন্তু খুব কম মানুষই জানেন, তার নামের সঙ্গেই মিলে যাওয়া আরেকজন অজানা বীর বিদ্রোহী ছিলেন— সুবেদার জয় মঙ্গল পাণ্ডে। তিনি ছিলেন সেই অগ্নিযুগের এক দীপ্তিমান যোদ্ধা, যিনি হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রতীক হয়ে সহযোদ্ধা নাদির আলীর সঙ্গে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।


ব্যারাকপুরের বিদ্রোহ সারা দেশে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিহারের দানাপুর ও রামগড় ছাউনির সৈনিকরাও ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রামগড় ছাউনিতে সেই সময় অবস্থান করছিলেন জয় মঙ্গল পাণ্ডে। তাঁর সঙ্গী নাদির আলীর সঙ্গে মিলে প্রায় ১৫০ সৈনিককে সংগঠিত করেন তিনি। এদিকে মহান বিপ্লবী কুনওয়ার সিং তখন ইংরেজদের কাছে আতঙ্কের নাম। জয় মঙ্গল পাণ্ডে ও নাদির আলীও তার দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং সশস্ত্র সৈনিকদের নিয়ে জগদীশপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
১১ই সেপ্টেম্বর ১৮৫৭-তে তারা চরতা পৌঁছন। খবর যায় কমিশনার সিম্পসনের কানে। তিনি দ্রুত ইংরেজ সেনাদের পাঠিয়ে দেন মেজর হংগলিশের নেতৃত্বে। প্রায় ৪০০ সৈন্য ও আধুনিক অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত ছিল সেই দল। এদিকে জয় মঙ্গল পাণ্ডে ও নাদির আলীর হাতে সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক কম, তবুও তাঁরা প্রাণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
২রা অক্টোবর ভোর থেকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। সারাদিন ধরে লড়াই চলতে থাকে। ইংরেজদের শক্তি ও অস্ত্রভাণ্ডার অনেক বেশি হলেও বিপ্লবীরা পিছু হটেননি। সংঘর্ষে ৫৮ জন ইংরেজ সৈন্য নিহত হয় এবং মেজর হংগলিশ অস্ত্রসহ কুয়োতে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু দেশি সৈনিকদেরও ভয়াবহ ক্ষতি হয়— অধিকাংশই মৃত্যুবরণ করেন।
অবশেষে ৩রা অক্টোবর জয় মঙ্গল পাণ্ডে ও নাদির আলী বন্দি হন। বিদ্রোহীদের মনোবল ভাঙতে, আতঙ্ক সৃষ্টি করতে ইংরেজরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন, ৪ঠা অক্টোবর ১৮৫৭ সালে, প্রকাশ্যে একটি আম গাছে ফাঁসি দেওয়া হয় এই দুই মহাবীরকে।
তাদের মৃত্যু শুধু শোক নয়, বরং এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যা প্রমাণ করে দিয়েছিল— হিন্দু ও মুসলমান, দুই কুসুম একই বৃন্তে ফুটে উঠতে পারে। মাতৃভূমির মুক্তির জন্য জীবন দিয়ে যাওয়া জয় মঙ্গল পাণ্ডে ও নাদির আলী চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন ইতিহাসের পাতায়।
✍️
লেখায়: প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ