বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছিল এমন এক সন্তান, যার বুকের রক্তে ছিল দেশপ্রেম, যার আত্মার প্রতিটি স্পন্দন বেজেছিল স্বাধীনতার গানে। ১৮৯২ সালের ৮ই অক্টোবর, বাংলাদেশের যশোর জেলার ঠাকুরপুর গ্রামে জন্ম নেন তিনি— বীর বিপ্লবী ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, যিনি আজও ইতিহাসের পাতায় রক্তে লেখা এক অক্ষয় নাম।
কৈশাল চন্দ্র দত্ত ও বিমলাসুন্দরী দেবীর সন্তান ভূপেন্দ্র ছিলেন শৈশব থেকেই মেধাবী, সাহসী ও মানবতাবোধে পূর্ণ। তার মা ছিলেন দানশীলা, আর পিতা ছিলেন ফরিদপুর জেলার পর্চার ম্যানেজার। কামালিনী, যাদুগোপাল, স্নেহলতা ও সুপ্রভা — এই চার সহোদরের মাঝে ভূপেন্দ্র ছিলেন এক আলাদা সত্তা, যার মন সদা জ্বলত জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়।
শৈশবে একদিন রামায়ণ পড়তে গিয়ে লক্ষণের বীরত্ব ও ব্রহ্মচর্যের প্রতিজ্ঞা তার মনে গভীর দাগ ফেলে। মায়ের কাছ থেকে ব্রহ্মচর্যের অর্থ জেনে তিনি নিজেও স্থির করেন, জীবনের বাকি সময় তিনি ব্রহ্মচর্যে থাকবেন, সৃষ্টিকর্তা ও মাতৃভূমির সেবায় নিয়োজিত থাকবেন। এবং সত্যিই, সেই প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই তিনি যোগ দেন অনুশীলন সমিতিতে, যেখানে দেশের স্বাধীনতার আগুন তার মনে আরও জ্বলে ওঠে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত প্রতিবাদে অংশ নেন এবং মানবিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়েন। বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারা ও ভগবদ্গীতার বাণী তাকে গড়ে তোলে এক দৃঢ়, ত্যাগী ও নীতিবান যোদ্ধায়।
তিনি ছিলেন বাঘা যতীনের মন্ত্রশিষ্য — সেই বিপ্লবী যিনি জার্মান অস্ত্রের সাহায্যে ভারতের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন। খুলনা ও যশোর অঞ্চলের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেন ভূপেন্দ্র। বাঘা যতীনের শহিদ হওয়ার পরেও তিনি আত্মগোপনে থেকে স্বাধীনতার আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। এমনকি আর্মেনিয়ান স্ট্রিট ডাকাতিতেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন, যা ছিল বিপ্লবী তহবিল সংগ্রহের অংশ।
১৯১৭ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং বিলাসপুর জেলে ৭৮ দিন অনশন ধর্মঘটের রেকর্ড গড়েন— যা আজও ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক কিংবদন্তি অধ্যায়। ১৯২০ সালে মুক্তি পেয়ে তিনি গান্ধীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ও গণসংযোগ বৃদ্ধির জন্য কংগ্রেসে যোগ দেন। পরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ পার্টিতে কাজ করেন। কিন্তু ব্রিটিশরা তাঁকে বারবার কারারুদ্ধ করে। ১৯২৩ সালে ব্রহ্মদেশে (বর্তমান মায়ানমার) বন্দী হন, মুক্তি পান ১৯২৮ সালে— তবুও অস্ত্র সংগ্রহ ও বিপ্লবের পথে অবিচল থাকেন।
১৯৩০ সালে যখন সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ঘটে, তখন তিনি ‘ধন্য চট্টগ্রাম’ নামে এক তীব্র দেশপ্রেমে ভরা নিবন্ধ লেখেন স্বাধীনতা পত্রিকায়। ফলস্বরূপ পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত হয়, এবং তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। এবার টানা আট বছর কারাভোগ করেন। মুক্তির পর ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ইংরেজি সাপ্তাহিক “ফরওয়ার্ড” সম্পাদনা করেন, যেখানে তাঁর লেখায় ফুটে উঠত নিপীড়িত জাতির আহ্বান।
দেশবিভাগের পর তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হন এবং সেখানেও আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে সক্রিয় থাকেন। এমনকি পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্যও হন তিনি। কিন্তু ১৯৬১ সালে সামরিক আইন জারি হলে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং রাজনীতি থেকে অবসর নেন।
জীবনের শেষপ্রান্তে তিনি লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘বিপ্লবের পদচিহ্ন’ এবং ‘Indian Revolution and the Constructive Program’ আজও বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি বহু বিপ্লবীর জীবনীও লিখেছেন, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য কতখানি ত্যাগে গড়া।
শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালের ২৯শে ডিসেম্বর এই মহান বিপ্লবী ইতিহাসের অমর পাতায় স্থান নেন। মৃত্যুর পরও তাঁর নাম উচ্চারিত হয় গর্বে, শ্রদ্ধায়, এবং একটাই উপলব্ধিতে—
“দেশের স্বাধীনতা রক্তে লেখা হয়, আর সেই রক্ত ছিল ভূপেন্দ্র কুমার দত্তের।”
লেখায় ::- প্রকাশ রায়


0 মন্তব্যসমূহ