প্রবাসে জ্বালানো স্বাধীনতার দীপ : লালা হরদয়াল

লালা হরদয়ালকে ভারতে ফিরিয়ে আনার সকল প্রকার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তাতে সফলতা আসেনি। ১৯২৭ সালে তিনি ইংল্যান্ডে থেকেই যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেখানে অবস্থানকালে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত গ্রন্থ “Doctrines of Bodhisattva”। ভারতীয়দের মনে তখন একটাই প্রশ্ন—“লালা হরদয়াল কি আর কখনো ভারতভূমিতে ফিরে আসবেন না?” কিন্তু সেই প্রত্যাবর্তন আর ঘটল না। ১৯৩৯ সালের ৪ই মার্চ, আমেরিকার ফিলাডেলফিয়াতে রহস্যজনকভাবে পর্দা নামল এই মহান বিপ্লবীর জীবনের।


আজ যার কথা বলছি তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক প্রেরণাদায়ক শক্তি, এক বিস্মৃত বিপ্লবী। বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নিজের নিরাপদ জীবনকে বিসর্জন দিয়ে আমেরিকার মাটিতে প্রতিষ্ঠা করেন “গদর পার্টি”—যার লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব। তিনি প্রবাসী ভারতীয়দের মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তাদের একত্রিত করেছিলেন দেশের মুক্তির আহ্বানে। তার সেই ডাক একসময় সমুদ্র পেরিয়ে ভারতের জনমানসে পৌঁছে যায়।
কাকোরী কাণ্ডের পর ১৯২৭ সালের মে মাসে লালা হরদয়ালকে ভারতে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার অনুমতি না দেওয়ায় সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। পরে ১৯৩৮ সালে পুনরায় তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়, তাতে এবার অনুমতি মিললেও, ভাগ্য যেন তখনও তার পক্ষে ছিল না। কারণ পরের বছরই—১৯৩৯ সালের ৪ মার্চ, ফিলাডেলফিয়ায় ঘটে যায় এক রহস্যময় মৃত্যু। তার বাল্যবন্ধু লালা হনুমন্ত সহায় দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেন—লালা হরদয়ালের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না, তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল।
এই মহান বিপ্লবীর জন্ম ১৮৮৪ সালের ১৪ই অক্টোবর, নতুন দিল্লির গুরুদুয়ারা শীশগঞ্জের পিছনে অবস্থিত চীরখানা মহল্লায়। কেমব্রিজ মিশন স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে তিনি সেন্ট স্টিফেনস কলেজ থেকে সংস্কৃত বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনে লালা হরদয়াল ছিলেন সাহসী, চিন্তাশীল এবং নেতৃত্বগুণে অনন্য।
লাহোরে এম.এ. পড়ার সময় তিনি লক্ষ্য করেন—তরুণদের জন্য বিনোদন বা বৌদ্ধিক বিকাশের কোনো উপযুক্ত স্থান নেই। একদিন একটি বিদ্যমান ক্লাবের সচিবের সঙ্গে বিবাদের পর তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন “ইয়ং ম্যান ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন”। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি তরুণ সমাজকে একত্রিত করার এবং জাতীয়তাবোধ জাগানোর কাজ শুরু করেন।
তখন লাহোর কলেজে অধ্যক্ষ ছিলেন মহান কবি ও দার্শনিক *মোহাম্মদ আল্লামা ইকবাল*—যিনি দর্শনশাস্ত্র পড়াতেন। হরদয়াল ও ইকবালের মধ্যে ছিল গভীর বন্ধুত্ব। লালার অনুরোধে ইকবাল এই ইয়ং ম্যান ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং সেখানে আবৃত্তি করেন তার অমর রচনা “সারে জহাঁ সে অচ্ছা”। ironical হলেও সত্য—যে গানটি একসময় ভারতের রাষ্ট্রীয় গানের মর্যাদা পায়, সেটিই প্রথম গাওয়া হয়েছিল এক বিপ্লবী হিন্দুর আহ্বানে!
আজ লালা হরদয়ালের নাম ইতিহাসের ধুলায় ঢাকা পড়ে গেছে। গদর আন্দোলনের সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যিনি একা হাতে বিদেশের মাটিতে জ্বালিয়েছিলেন স্বাধীনতার দীপ, তাকে আজ কেউ মনে রাখে না। অথচ তিনিই প্রবাসী ভারতীয়দের শিখিয়েছিলেন—দেশ থেকে দূরে থাকলেও দেশপ্রেমকে ভুলে যাওয়া যায় না। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তার নাম হয়তো মলিন হয়ে গেছে, কিন্তু তার কর্ম ও আদর্শ আজও দেশপ্রেমের অনন্ত প্রেরণা হয়ে আছে।
✍️
কলমে: প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ