অগ্নিবীর সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : যিনি মৃত্যুকেও পরাজিত করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য

বেহালার মাটিতে ১৮৮৯ সালের ১৭ অক্টোবর জন্ম নিয়েছিল এক আগুন—যে আগুনের নাম সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। পিতা মন্মথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্তান হলেও, তিনি জন্মেছিলেন কেবল একটি পরিবারের নয়—একটি জাতির মুক্তির জন্য। ছোটবেলা থেকেই তাঁর চোখে ফুটে উঠেছিল বিদ্রোহের শিখা, বুকের ভেতর দাউদাউ করে জ্বলত স্বাধীনতার তৃষ্ণা।


হরিনাভি স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন ১৯০৫ সালে, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা জানানোয় যখন স্কুল কর্তৃপক্ষ মানবেন্দ্রনাথ রায়সহ বেশ কয়েকজন ছাত্রকে বহিষ্কার করল, তখন তাঁদের সঙ্গে বহিষ্কৃতদের সারিতেও দাঁড়িয়েছিলেন সাতকড়ি। তখনই শুরু হয় তাঁর বিপ্লবযাত্রা। যুগান্তর দলের প্রবীণ বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এসে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার এক দুর্ধর্ষ যুবযোদ্ধা।
১৯১৪ সালে, যখন গদর পার্টির সাহসী বিপ্লবীরা ‘কোমাগাতামারু’ জাহাজে বজবজে এসে পৌঁছালেন, সাতকড়ি তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। ইংরেজ শাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনে তাঁদের আশ্রয় ও সহযোগিতা দেন—কারণ, তাঁর কাছে ভারতমাতার সেবা ছিল সর্বোচ্চ ধর্ম।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি গেরিলা যুদ্ধের জন্য মানচিত্র, নকশা ও রণকৌশল সংগ্রহ করতেন। ১৯১৫ সালে বাঘা যতীন তাঁকে পাঠালেন হ্যালিডে দ্বীপে—জার্মান অস্ত্রবাহী জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের গুরুদায়িত্ব নিয়ে। অস্ত্র খালাসের পরিকল্পনায় তিনিই ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। যদিও নানা কারণে সেই অভিযান সফল হয়নি, সাতকড়ির সাহস ও ত্যাগের কথা ইতিহাস আজও স্মরণ করে।
সেই বছরই তিনি নিরালম্ব স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করতে যান বাঘা যতীনের দূত রূপে। তাঁর ওপরই ছিল যুগান্তর দলের বৈদেশিক বিভাগের দায়িত্ব—এমন এক ভূমিকা, যা ছিল বিপ্লবী ইতিহাসের কেন্দ্রে। ১৯৩০ সালে সাতকড়ি জড়িয়ে পড়েন ইংরেজদের ত্রাস চার্লস টেগার্ট-এর হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনায়। তিনি জানতেন, ধরা পড়লে মৃত্যু অনিবার্য, তবু থামেননি—কারণ স্বাধীনতার মন্ত্র তাঁর রক্তে মিশে গিয়েছিল।
যুগান্তরের বারুইপুর শাখার নেতা হিসেবে সাতকড়ি হয়ে ওঠেন বহু তরুণ বিপ্লবীর প্রেরণা। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন শহীদ কানাইলাল ভট্টাচার্য, যিনি তাঁরই পরামর্শে ২৭ জুলাই ১৯৩১ সালে বিচারক গার্লিককে ‘বিমল গুপ্ত’ ছদ্মনামে হত্যা করেন।
৪ মার্চ ১৯১৬ সালে সাতকড়ি গ্রেপ্তার হন। আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাঁকে পাঠানো হয় নৈনি জেলে। সেখানে রাজবন্দীদের ওপর অমানবিক অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি ৬৭ দিন অনশন করেন—যে অনশন ইতিহাসে অমর হয়ে আছে এক অবিনাশী সংকল্পের প্রতীক হয়ে। ১৩ জানুয়ারি ১৯২০ সালে মুক্তি পেয়েও আবার ফিরে যান সংগঠনের কাজে।
১৯২৪ সালে আবার গ্রেপ্তার, তিন বছরের কারাদণ্ড। ১৯২৭ সালে মুক্তি পেলেও তাঁর বিপ্লবী কাজ থামেনি। ১৯৩০ সালে তাঁকে স্বগৃহে অন্তরীণ রাখা হয়, পরে ১৯৩২ সালে দেউলি বন্দীশিবিরে পাঠানো হয়। ইংরেজরা হয়তো তাঁর দেহ বন্দি রাখতে পেরেছিল, কিন্তু তাঁর মন—তার আগুন—কখনো নয়।
অবশেষে ১৯৩৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, দেউলির বন্দীশিবিরেই অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর আত্মা আজও মুক্তির আকাশে উড়ে বেড়ায়।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন—
“দেশের স্বাধীনতা রক্ত ছাড়া অর্জিত হয় না, আর সেই রক্তের প্রথম বিন্দু ঝরাতে ভয় পায় না সত্যিকারের বিপ্লবী।”
সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু এক নাম নয়, এক অমর প্রতীক — দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও অদম্য সাহসের প্রতিচ্ছবি।
লেখায়: প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ