ফাঁসির মঞ্চে বঙ্গ সন্তান ব্রজকিশোর চক্রবর্তী

এক অনন্য সাহসী তরুণ, যিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বেঁচে আছেন অমরত্বে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তার নাম লেখা আছে রক্তাক্ষরে। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য যিনি হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে পা রেখেছিলেন, তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই বীর সন্তান। তাঁর দেশপ্রেম, ত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনি আজও প্রজন্মকে জাগিয়ে রাখে। এই মহান বিপ্লবীর নাম ইতিহাসে গৌরবে দীপ্ত — ব্রজকিশোর চক্রবর্তী।

ব্রজকিশোর চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৩ সালে, মেদিনীপুর জেলার বল্লভপুর গ্রামে। তাঁর পিতা উপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন এক সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি, যিনি ছেলেকে শৈশব থেকেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই ব্রজকিশোর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি গোপন বিপ্লবী সংগঠন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে যোগ দেন—একটি সংগঠন, যা তখন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গোপন সশস্ত্র আন্দোলন চালাচ্ছিল। তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, সাহস এবং নেতৃত্বগুণ তাঁকে সংগঠনের অন্যতম প্রধান সদস্যে পরিণত করে।
১৯৩৩ সালের ২রা সেপ্টেম্বরের দিনটি ভারতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। সেদিন শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ সাহেব মেদিনীপুর কলেজ মাঠে মোহামেডান স্পোর্টিং-এর বিরুদ্ধে মেদিনীপুর ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলতে নামেন। বিপ্লবী অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত খেলার ছলে বল হাতে মাঠে প্রবেশ করেন। মুহূর্তেই তারা আক্রমণ চালান বার্জ সাহেবের উপর। ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ নিহত হন এবং এক ইংরেজ কর্মকর্তা জোন্স আহত হন। পুলিস প্রহরীরা পাল্টা গুলি চালায়, তাতে দুই বীর বিপ্লবী অনাথবন্ধু ও মৃগেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর শুরু হয় বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড়।
ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায়, নির্মলজীবন ঘোষ, নন্দদুলাল সিং, কামাখ্যা ঘোষ, সুকুমার সেন ও সনাতন রায়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হয়। দীর্ঘ বিচারের পর রায় আসে—ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায় ও নির্মলজীবন ঘোষকে ফাঁসির আদেশ; আর বাকিদের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও ব্রজকিশোর ছিলেন শান্ত ও দৃঢ়চেতা। তিনি সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “দেশের স্বাধীনতার জন্য যদি আমার মৃত্যু হয়, তবে তা আমার গর্ব, আমার সাধনা।”
১৯৩৪ সালের ২৫শে অক্টোবর ভোরবেলা, মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের ফাঁসির মঞ্চে যখন ব্রজকিশোর চক্রবর্তী এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর মুখে ছিল বিজয়ের হাসি। তিনি চিরদিনের মতো মিশে গেলেন স্বাধীনতার রক্তধারায়। মাত্র ২১ বছর বয়সে ফাঁসি হলেও, তাঁর আত্মত্যাগ আজও আমাদের প্রেরণার উৎস।
বাংলার এই তরুণ বিপ্লবীর নাম আজও গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। মেদিনীপুরের মাটিতে তাঁর স্মৃতি আজও জীবন্ত। তাঁর মতো সাহসী সন্তানেরাই এই দেশের স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ব্রজকিশোর চক্রবর্তী ছিলেন শুধু এক বিপ্লবী নন—তিনি ছিলেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা, এক অদম্য আত্মা, যিনি মৃত্যুর মধ্যেও খুঁজে পেয়েছিলেন মুক্তির আলো।
- লেখায়: প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ