দেশের জন্য যিনি ফাঁসির দড়িকে ভালোবেসে হাসিমুখে আলিঙ্গন করেছিলেন, যিনি মৃত্যুর মুহূর্তেও উচ্চারণ করেছিলেন — “বন্দে মাতরম্!”, তিনি ছিলেন বাংলার এক অমর সন্তান, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া এক মহান বীর। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় সাহস, আত্মত্যাগ আর দেশপ্রেমে পরিপূর্ণ। তিনি হলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় বিপ্লবী নির্মলজীবন ঘোষ।
নির্মলজীবন ঘোষ ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অমর বিপ্লবী। মৃত্যুকে তিনি দেখেছিলেন দেশের মুক্তির সোপান হিসেবে। তাঁর এক ভাই নবজীবন ঘোষও ছিলেন দেশপ্রেমিক বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশ পুলিশের নির্মম অত্যাচারে জেলেই প্রাণ হারান। আরেক ভাইও ছিলেন মহান বিপ্লবী। বলা চলে, তাঁদের পরিবারই ছিল দেশমাতৃকার সেবায় উৎসর্গীকৃত এক পরিবার। যেমন মহারাষ্ট্রের তিন ভাই ‘চাপেকর ভ্রাতা’ স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান দিয়েছিলেন, তেমনই বাংলার এই ঘোষ পরিবারও ইতিহাসে নিজেদের স্থান করে নিয়েছিলেন অনন্য সাহসের প্রতীক হিসেবে।
হুগলির ধামসিন গ্রামে ১৯১৬ সালের ৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন নির্মলজীবন ঘোষ। পিতা যামিনীজীবন ঘোষ। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা ও দেশপ্রেমিক। মেদিনীপুর কলেজে আই.এ. শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তাঁর মনে দেশপ্রেমের আগুন জ্বলে ওঠে। তিনি যোগ দেন গোপন বিপ্লবী সংগঠন ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’-এ। এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের শোষণনীতি রুখে দাঁড়ানো এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করা।
সেই সময় মেদিনীপুর জেলার ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ সাহেব ছিলেন বিপ্লবীদের জন্য এক ভয়ঙ্কর বাধা। তাঁর অত্যাচার, অপমান, ও বিদ্রূপে তিলে তিলে জ্বলছিল তরুণ বিপ্লবীদের হৃদয়। অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় — এই দানবীয় প্রশাসকের অবসান ঘটাতেই হবে।
১৯৩৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর, মেদিনীপুর কলেজ মাঠে ফুটবল ম্যাচ চলাকালীন সময়ে বিপ্লবীরা পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করেন বার্জ সাহেবকে। বিপ্লবী অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত খেলার ছলে মাঠে প্রবেশ করেন এবং কাছ থেকে গুলি চালান। ঘটনাস্থলেই বার্জ মারা যান, আহত হন জোন্স নামে এক ইংরেজ। দুই বীর বিপ্লবী তৎক্ষণাৎ পুলিশের গুলিতে মারা যান, অন্যরা সাফল্যের সঙ্গে পালিয়ে যান।
এরপর শুরু হয় ব্যাপক অভিযান। একে একে ধরা পড়েন নির্মলজীবন ঘোষ, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায়, নন্দদুলাল সিং, কামাখ্যা ঘোষ, সুকুমার সেন এবং সনাতন রায়। দীর্ঘ বিচার শেষে তিনজন বিপ্লবীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয় — নির্মলজীবন ঘোষ, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী এবং রামকৃষ্ণ রায়।
১৯৩৪ সালের ২৫ অক্টোবর ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ব্রজকিশোর চক্রবর্তী ও রামকৃষ্ণ রায়কে। আর ২৬ অক্টোবর, ভোরের আলো ফোটার আগেই নির্মলজীবন ঘোষ মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের ফাঁসির মঞ্চে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। তাঁর ঠোঁটে তখনও জ্বলছিল স্বাধীনতার মন্ত্র — “বন্দে মাতরম্!”
এই মহাবীরের আত্মত্যাগ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অমর অধ্যায়। তাঁর ভাই নবজীবন ঘোষের মতোই তিনি দেখিয়েছেন — স্বাধীনতার মূল্য জীবন দিয়েও দিতে হয়। বাংলার এই পরিবার আজও ইতিহাসে অমর, যেমন মহারাষ্ট্রের চাপেকর ভ্রাতারা।
আজ তাঁর জন্মদিনে বা মৃত্যু দিবসে আমরা মাথা নত করি শ্রদ্ধায়, গর্বে ও কৃতজ্ঞতায়।
তাঁর মতো সাহসী সন্তানদের কারণেই আমরা আজ স্বাধীনতার আলো দেখতে পেয়েছি।
চিরঅমর বিপ্লবী নির্মলজীবন ঘোষকে প্রণাম 

0 মন্তব্যসমূহ