যাদের জীবন ও ত্যাগ আজও বাংলার মাটিতে স্বাধীনতার এক গর্বিত ইতিহাস হয়ে বেঁচে আছে। তারা ছিলেন ভারতীয় ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত, যাদের রক্তে লেখা হয়েছে মেদিনীপুরের বিপ্লবের অমর কাহিনি। গোপন বিপ্লবী সংগঠন ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’-এর সদস্য হিসেবে তারা অংশ নেন ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব অভিযানে। মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ হত্যাকাণ্ডে তারা অভিযুক্ত হন এবং শেষ পর্যন্ত প্রাণ বিসর্জন দেন দেশের জন্য। স্বাধীনতার সেই ত্যাগের ইতিহাসে আজও জ্বলজ্বল করছে তাদের নাম —রামকৃষ্ণ রায় ও ব্রজকিশোর চক্রবর্তী।
রামকৃষ্ণ রায়ের জন্ম ১৯১২ সালের ৯ জানুয়ারি। তার পিতার নাম কেনারাম রায়। তখন ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারে বাংলার মানুষ দমবন্ধ হয়ে আছে। মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ ছিলেন বিপ্লবীদের পথে প্রধান অন্তরায়। এই বার্জকে সরাতে না পারলে স্বাধীনতার লড়াই থমকে যাবে — এমনটাই বুঝেছিলেন তারা। তাই গোপনে তৈরি হয় পরিকল্পনা। দিনটি ছিল ২রা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৩ সাল। সেই দিন ইতিহাসের পাতায় চিরকাল লেখা থাকবে রক্তাক্ষরে। বার্জ সাহেব মাঠে নেমেছিলেন ফুটবল খেলতে — মেদিনীপুর কলেজ মাঠে মোহামেডান স্পোর্টিং-এর বিরুদ্ধে। ঠিক তখনই খেলার ছলে বিপ্লবী অনাথবন্ধু পাঁজা ও বিপ্লবী মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত বল হাতে মাঠে নামেন। মুহূর্তের মধ্যে গর্জে ওঠে বীরের হাত — বার্জকে আক্রমণ করেন তারা, এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ইংরেজ জোন্স আহত হন, পুলিস পাল্টা গুলি চালায়। দুই বিপ্লবী অনাথবন্ধু ও মৃগেন্দ্রনাথ সেদিন বীরগতি প্রাপ্ত হন, বাকিরা পলায়ন করতে সক্ষম হন।
এই ঘটনার পর ইংরেজ সরকার তাণ্ডব চালায়। ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হয় ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায়, নির্মলজীবন ঘোষ, নন্দদুলাল সিং, কামাখ্যা ঘোষ, সুকুমার সেন ও সনাতন রায়ের বিরুদ্ধে। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার শেষে রায় আসে—ব্রজকিশোর, রামকৃষ্ণ ও নির্মলজীবনের ফাঁসি; আর বাকি চারজনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের দণ্ড। স্বাধীনতার জন্য তারা হাসিমুখে মেনে নেন মৃত্যুর দাওয়াত।
১৯৩৪ সালের ২৫শে অক্টোবর, মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের ফাঁসির মঞ্চে উঠে গেলেন বাংলার সেই দুই অমর সন্তান। রক্তে রাঙা হল দেশের মাটি, মাথা নত করল পুরো মেদিনীপুর। আজও তাদের আত্মত্যাগের কাহিনি শুনলে বুক গর্বে ভরে ওঠে, চোখে আসে অশ্রু। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, আধুনিক প্রজন্ম ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছে এই দুই মহামানবকে — ব্রজকিশোর চক্রবর্তী ও রামকৃষ্ণ রায়কে, যাদের ত্যাগের আলোয় আজও জ্বলে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য।
- লেখায়: প্রকাশ রায়


0 মন্তব্যসমূহ