এক অমর নাম, এক অনন্য আত্মবলিদান। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি চিরভাস্বর, কারণ তিনিই সেই বীর, যিনি ৬২ দিন অনশন করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন লাহোরের বোস্টল জেলে — ১৯২৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর। মৃত্যুকে পরোয়া না করে, দেশের মর্যাদার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন যে তরুণ, তিনি হলেন মহান বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ দাস।
১৯০৪ সালের ২৭শে অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন যতীন দাস। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী ও চিন্তাশীল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিপ্লবীদের জীবনকথা পড়ে নিজের ভিতরে আগুন জ্বালিয়েছিলেন। ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনে পড়াকালীন স্বদেশপ্রেমের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল তার মনে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে, ১৯২০ সালে, মেট্রিক পাশ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের আন্দোলনে।
সেই সময় মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল সারা দেশে। ছাত্র, শিক্ষক, আইনজীবী, সরকারি কর্মচারী — সবাই অংশ নিচ্ছেন স্বাধীনতার দাবিতে। সেই সময়ের এক কিশোর যতীন্দ্রনাথ নিজের স্কুলের ধর্মঘট থেকে শুরু করে রাস্তায় মিছিল পরিচালনা করেছেন। তাঁর তেজ, সাহস আর নেতৃত্ব দেখে প্রবীণ বিপ্লবীরাও বিস্মিত হয়েছিলেন। কেউ কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন — “এই কিশোর একদিন ভারতের ইতিহাসে অমর নাম রেখে যাবে।”
তরুণ যতীন্দ্রনাথ শুধু বিপ্লব নয়, সমাজসেবাতেও ছিলেন অগ্রণী। ১৯২১ সালের ভয়ঙ্কর বন্যা ও মহামারীর সময় নিজের জীবন বিপন্ন করে তিনি গঠন করেছিলেন ত্রাণ কমিটি, এবং নিরন্তর কাজ করে গিয়েছিলেন অসহায় মানুষের পাশে। পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি দমে যাননি, বরং আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন।
১৯২৩ সালে তিনি যোগ দেন বিপ্লবী সংগঠন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন-এ। বিশিষ্ট বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যালের অনুপ্রেরণায় ভবানীপুরে গোপন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। যতীন দাসের কাজ ছিল দেশপ্রেমিক তরুণদের শনাক্ত করে দলে অন্তর্ভুক্ত করা — এবং তাতে তিনি ছিলেন অসাধারণ সফল। পরবর্তীকালে দক্ষিণেশ্বরের বিপ্লবীদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
১৯২৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “তরুণ সমিতি”। পুলিশের কুনজরে পড়েন, এবং মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা জেলে বন্দী হন। সেখানকার অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে টানা ২৩ দিন অনশন করেন — যা ছিল তার প্রথম মহাবলিদান।
পরবর্তীতে মুক্তি পেয়ে তিনি আবার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় লালা লাজপত রায়ের উপর পুলিশের নির্মম লাঠিচার্জে তাঁর মৃত্যু ঘটলে যতীন্দ্রনাথ গভীরভাবে ক্ষুব্ধ হন। প্রতিশোধ নিতে ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেব প্রমুখের সঙ্গে পরিকল্পনা করেন স্কটকে হত্যা করার — যদিও ভুলবশত নিহত হন অফিসার স্যান্ডার্স।
এই ঘটনার পর শুরু হয় “লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা”। ১৯২৯ সালের ১৪ই জুন যতীন্দ্রনাথ দাসকে গ্রেপ্তার করে পাঠানো হয় লাহোর জেলে। জেলের ভিতরকার অমানবিক পরিস্থিতি, নোংরা খাবার, চিকিৎসার অভাব দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন রাজনৈতিক বন্দীদের মর্যাদার দাবিতে অনশন করবেন। তাঁর সঙ্গে অন্যান্য বন্দীরাও যোগ দেন। দিন কেটে যায় — ৩০ দিন, ৪০ দিন, ৫০ দিন... তবুও তিনি অনড়।
সরকার জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করে, নাকে নল ঢুকিয়ে খাবার দিতে গিয়ে তা ফুসফুসে ঢুকে যায় — ফলে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন যতীন দাস। তাঁর শারীরিক অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যায়। ডাক্তাররা বলেন, আর বাঁচানো যাবে না। তবুও তিনি দৃঢ় থাকেন নিজের সিদ্ধান্তে। অবশেষে ১৯২৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর দুপুর ১টা ৫ মিনিটে, ৬৩ দিনের মাথায়, নিঃশব্দে থেমে যায় এক অগ্নিযোদ্ধার হৃদস্পন্দন।
তাঁর দেহ লাহোর থেকে কলকাতায় আনার ব্যবস্থা করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। হাওড়া স্টেশনে লক্ষ লক্ষ মানুষ অপেক্ষা করেছিল বীর মৃত্যুঞ্জয়ীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। পুলিশের হিসাবে প্রায় ছয় লক্ষ মানুষ তাঁর শবযাত্রায় অংশ নেন। আগুনে পুড়ে গেল তাঁর দেহ, কিন্তু অমর হয়ে রইল তাঁর আত্মত্যাগ — বাংলার দধীচি যতীন্দ্রনাথ দাসের ত্যাগগাথা।
- লেখক: প্রকাশ রায়


0 মন্তব্যসমূহ