যিনি মাতৃভূমির মুক্তির জন্য নিঃস্বার্থে জীবনকে বাজি রেখেছিলেন, তিনি আর কেউ নন — পরীক্ষিৎ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, যাকে সবাই চিনত ভালোবেসে “কাঙালদা” নামে।
১৮৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার খর্ণিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা গুরুচরণ মুখোপাধ্যায় ও মাতা কমলিনী দেবীর স্নেহধন্য পরীক্ষিৎ ছোটবেলা থেকেই দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হন। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই (১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়) এম.এন. রায় (নরেন ভট্টাচার্য), শশাঙ্ক জোয়ারদার, নগেন দত্ত প্রমুখের সংস্পর্শে এসে তিনি যুক্ত হন অনুশীলন সমিতিতে। সেবার তিনি বন্যার ত্রাণ কাজেও সক্রিয় ভূমিকা নেন।
পরে বাঘা যতীনের নেতৃত্বে এবং ড. যাদুগোপাল মুখার্জির তত্ত্বাবধানে তিনি বিপ্লবী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। কৃষ্ণকুমার মিত্র, এইচ.এন. বসু, এস.এন. হালদার প্রমুখ হাইকোর্টের ব্যারিস্টারদের সহায়তায় তিনি পাঁচ-ছয় মাস বিপ্লবী কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ‘সারা ভারত বিপ্লব’-এর ডাক আসতেই তিনি যোগ দেন নেতা যতীন মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীনের দলে। পাঞ্জাবি সৈন্যদের স্বাধীনতার আন্দোলনে টানতে বিপ্লবীরা যে পরিকল্পনা নেন, সেখানে পরীক্ষিৎকে কম্পাউন্ডারি পাস করিয়ে মেডিকেল দলের অংশ করা হয়।
অস্ত্র কেনার জন্য অর্থের প্রয়োজনে তিনি পূর্ণচন্দ্র দাসের দলে যোগ দেন। সেখানেই ঘটে খিদিরপুরের ‘বার্ড অ্যান্ড কোং’ ডাকাতি এবং বেলেঘাটার চাউলপট্টির দুঃসাহসী অভিযান, যা ছিল সম্পূর্ণ সফল।
১৯১৪ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং বাংলার বিভিন্ন কারাগারে ‘ষ্টেট প্রিজনার’ হিসেবে বন্দী রাখে। রেগুলেশন অ্যাক্ট-৩ অনুযায়ী তিনি প্রেসিডেন্সি জেলের কুখ্যাত ৪৪-ডিগ্রিতে কয়েক মাস আটক ছিলেন। ১৯১৮ সালে হাজারীবাগ সেন্ট্রাল জেলে তিনি অরুণ চন্দ্র গুহর সঙ্গে রাজনৈতিক বন্দীদের প্রতি অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে টানা ৪৫ দিনের অনশন করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯১০ সালে মুক্তি পেলেও ১৯৩১ সালে আবারও তিনি শিয়ালদহ বোমা মামলায় গ্রেপ্তার হন। দীর্ঘ কারাবাসের পর ১৯৩৮ সালে ড. যাদুগোপাল মুখার্জির আহ্বানে যোগ দেন জাতীয় কংগ্রেসে এবং খুলনা জেলার সাতক্ষীরা থেকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তবে স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।
রাজনৈতিক জীবনে তাঁর নিকটতম সহযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন বাঘা যতীন, ড. যাদুগোপাল মুখার্জি, এম.এন. রায়, চিত্তপ্রিয়, মনোরঞ্জন, কালীচরণ ঘোষ, সতীশ চক্রবর্তী, অরুণ চন্দ্র গুহ, ভোলা চ্যাটার্জী, ভূপতি মজুমদার প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরীক্ষিৎ চন্দ্র লড়েছেন মাতৃভূমির মুক্তির জন্য।
১৯৫৬ সালের ২৬ নভেম্বর, কলকাতার নিজের বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দেশ তাঁকে মনে রাখবে চিরকাল একজন অকুতোভয়, নিঃস্বার্থ সৈনিক হিসেবে, যিনি মাতৃভূমির জন্য জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন।
- লেখায় - প্রকাশ রায়


0 মন্তব্যসমূহ