অগ্নিরাণী ভেলু নাচিয়ার — ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী রাণী

ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এমন কিছু নাম লেখা থাকে, যেগুলো যুগ পেরিয়েও অনুপ্রেরণার শিখা জ্বালিয়ে রাখে। তেমনই এক অগ্নিনারী ছিলেন রাণী ভেলু নাচিয়ার, যিনি ১৭৮০ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম রাণী হিসেবে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও আত্মত্যাগ তাঁকে পরিণত করেছে ভারতের ইতিহাসে এক অনন্য বিপ্লবী রাণীতে — “বীরমঙ্গাই”, অর্থাৎ এক সত্যিকারের বীরাঙ্গনায়!

২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভারতের ডাক বিভাগ তাঁর সম্মানে প্রকাশ করে একটি স্মারক ডাকটিকিট।

১৭৩০ সালের ৩ জানুয়ারি রামনাথপুরম রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ভেলু নাচিয়ার। তিনি ছিলেন রাজা চেল্লামুথু বিজয়রঘুনাথ সেতুপতি এবং রানী সাকান্ধিমুথালের একমাত্র কন্যা। ছোটবেলা থেকেই তিনি রাজকুমারীর আদলে নয়, বরং যোদ্ধার মতো প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। ভালারি, সিলাম্বাম, ঘোড়সওয়ারি, তীরন্দাজি — সবেতেই ছিলেন পারদর্শী। শুধু তাই নয়, তিনি ফরাসি, ইংরেজি ও উর্দু ভাষাতেও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন — যা তখনকার সময়ে এক রাজরাণীর জন্য বিরল প্রতিভা।
পরবর্তীতে তিনি শিবগঙ্গার রাজা মুথুভাদুগনাথাপেরিয়া উদয়াথেভরকে বিবাহ করেন। তাঁদের সংসারে জন্ম নেয় এক কন্যা, ভেল্লাচ্চি। কিন্তু শান্ত জীবনের অবসান ঘটে যখন তাঁর স্বামীকে ব্রিটিশ সৈন্য এবং আর্কট নবাবের পুত্র হত্যা করে। সেই ঘটনাই তাঁর জীবনে অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে দেয়। প্রিয় স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তিনি কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যান দিন্দিগুলে, পলয়কারর কোপালা নায়াক্করের আশ্রয়ে। সেখানে তিনি আট বছর ধরে গোপনে সেনাদল গঠন করেন এবং যুদ্ধে ফিরে আসার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন।
এই সময় তিনি হায়দার আলীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হন — মাইসোরের বীর রাজা, যিনি ব্রিটিশদের চোখে কাঁটা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের মিলিত কৌশলে ১৭৮০ সালে শিবগঙ্গার ভূমিতে শুরু হয় এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ। রাণী ভেলু নাচিয়ার নিজের হাতে নেতৃত্ব দেন সেই যুদ্ধের, যেটি ছিল ভারতের প্রথম নারী-নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বিদ্রোহ।
কিন্তু তাঁর পরিকল্পনার মধ্যে ছিল এক ভয়ংকর কৌশল। যখন তিনি জানতে পারেন ব্রিটিশদের গোলাবারুদ কোথায় রাখা হয়েছে, তখন তিনি আত্মঘাতী অভিযানের নির্দেশ দেন। তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গিনী কুইলি তেলের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ব্রিটিশ অস্ত্রাগারে প্রবেশ করেন, এবং এক মহাবিস্ফোরণে ধ্বংস করে দেন তাদের শক্ত ঘাঁটি। কুইলির আত্মত্যাগের স্মরণে ভেলু নাচিয়ার গঠন করেন ভারতের প্রথম নারী সেনাদল— “উদাইয়াল বাহিনী”, তাঁর পালিতা কন্যা উদাইয়ালের নামে, যিনি একই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন।
এই অগ্নিরাণী শুধু রাজ্য পুনর্দখলই করেননি, দশ বছর শাসনও করেছেন বিচক্ষণতার সঙ্গে। ১৭৯০ সালে তাঁর কন্যা ভেল্লাচ্চি সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে কখনও ভোলেনি— কারণ তিনিই ছিলেন ভারতের স্বাধীনতার প্রথম নারী সেনানায়ক, যিনি ব্রিটিশদের চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন— “আমার দেশ স্বাধীন থাকবে, যতদিন আমার অস্তিত্ব আছে।”
১৭৯৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর, রাণী ভেলু নাচিয়ার চিরবিদায় নেন, কিন্তু রেখে যান অমর সাহসের উত্তরাধিকার। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভারতের ডাক বিভাগ তাঁর সম্মানে প্রকাশ করে একটি স্মারক ডাকটিকিট। চেন্নাই, মাদুরাই এবং তামিলনাড়ুর মঞ্চে আজও তাঁর জীবনী নৃত্যনাট্যে অমর হয়ে আছে।
২০১৬ সালে তামিল-আমেরিকান শিল্পী প্রফেসর এ.এল. আই তাঁর নামে গান প্রকাশ করেন “আমাদের রাণী” শিরোনামে— আর সত্যিই, তিনি কেবল তামিলদের নয়, সমগ্র ভারতের রাণী।
তিনি শুধু এক যোদ্ধা ছিলেন না, ছিলেন এক প্রেরণার প্রতীক— নারী শক্তির জাগরণের অগ্নিশিখা। অগ্নিরাণী ভেলু নাচিয়ার — ভারতের স্বাধীনতার প্রথম নারী যোদ্ধা।

— লেখায়
✍️
প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ