ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে, যাদের বয়সের তুলনায় সাহস ছিল অগণিত—তারা যেন ঝড়ের মতো এসে আলো ছড়িয়ে চলে গেছেন। তেমনই এক অমলিন নাম শান্তি ঘোষ, যার জন্ম ২২ নভেম্বর ১৯১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। মাত্র পনেরো বছর বয়সে, সুনীতি চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিটিশ শাসনের কাঁপন ধরানো যে ঘটনা ঘটেছিল—তা আজও ইতিহাসে লেখা আছে আগুনের অক্ষরে। এই দু’জন অল্পবয়সী কিশোরীর গুলিতেই কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সের পতন ঘটে। সেই দিন থেকেই বাংলা বুঝেছিল—স্বাধীনতার জন্য বয়স নয়, চাই শুধু অদম্য সাহস আর আগুনঝরা হৃদয়।
![]() |
| শান্তি ঘোষ |
শান্তি ঘোষের এই সাহসী হয়ে ওঠার পিছনে যেমন ছিল সময়ের অস্থির ইতিহাস, তেমনি ছিল তাঁর পরিবার—বিশেষ করে তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঘোষের প্রেরণা। তিনি ছিলেন কুমিল্লা কলেজের প্রফেসর, দর্শনের শিক্ষক ও দেশপ্রেমিক মন। পিতার মুখে স্বাধীনতার কথা শুনে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখে ছোট্ট শান্তি। স্বপ্ন দেখতে শেখে—দেশকে মুক্ত করার স্বপ্ন। ফয়জুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াকালীন তাঁর জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আসে—প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্মার সংস্পর্শ। তাঁর হাত ধরেই শান্তির পরিচয় হয় যুগান্তর পার্টির সঙ্গে। সশস্ত্র বিপ্লবীদের কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে এক কিশোরী রূপ নিচ্ছিল অগ্নিযোদ্ধায়।
প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ হলে যুগান্তর শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরীকে দেয় এক ভয়াবহ দায়িত্ব—ইংরেজ শাসনের অত্যাচারী প্রতীক ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৩১—এই দিনটি ইতিহাসে রয়ে গেছে দুটি কিশোরীর সাহসের সাক্ষী হিসেবে। শান্তির বয়স তখন মাত্র ১৫, আর সুনীতির ১৪। কুমিল্লার রাস্তায় প্রতিশোধের বজ্রনিনাদ তুলেছিল দুই কিশোরী। পরে তাঁরা ধরা পড়েন এবং ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার আদালতে বিচার হয়।
বিচারকের রায়ে তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলে শান্তির মনে খেদ জাগে—কারণ তিনি ভেবেছিলেন তাঁর কঠিনতম আত্মত্যাগের মূল্য হবে ফাঁসির দণ্ড। কিন্তু ইতিহাস তাঁর জন্য অন্য পথ লিখেছিল। একই ঘটনার সূত্রে গোপাল দেবও গ্রেফতার হয়ে আন্দামানে দ্বীপান্তর দণ্ড পান। শান্তি ঘোষ বন্দিজীবনের কঠিন বাস্তবতার মধ্যে যেমন নিজের আদর্শ আঁকড়ে ছিলেন, তেমনি ছিলেন অদম্য, অবিচল। হিজলি বন্দী নিবাসেও কাটান বেশ কিছুদিন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৩৯ সালে রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে তিনি মুক্তি পান।
জেল থেকে বেরিয়ে নতুন জীবনের সূচনা করেন শান্তি। আবার পড়াশোনা শুরু করেন, যোগ দেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। পরে কংগ্রেসে এসে যুক্ত হন গণরাজনীতিতে। দেশের মানুষের জন্য কাজ করার যে আগুন তাঁর মনে জন্মেছিল, তা রাজনীতির পথেও ছড়িয়ে পড়েছিল সমান উজ্জ্বলতায়। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ এবং পরে ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৮ অবধি বিধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সংগ্রাম তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
২৭ মার্চ ১৯৮৯—এই দিনে চিরনিদ্রায় শায়িত হন শান্তি ঘোষ। কিন্তু তাঁর নাম, তাঁর সাহস, তাঁর মিষ্টি অথচ আগুনঝরা প্রতিবাদ আজও বাংলা ও ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসে উজ্জ্বল। পনেরো বছরের সেই কিশোরীর গুলির ঝংকার আজও যেন আমাদের মনে শোনায়—অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তিই প্রকৃত স্বাধীনতার শপথ।
— ✍️ লেখায়: প্রকাশ রায়