মাতঙ্গিনী হাজরা

আমাদের দেশের মেয়েরা সুযোগ পেলে কতটা উঁচুতে উঠতে পারে, কত বড় কাজ সমাধান করতে পারে—তা বোঝার জন্য কারও জীবনের দিকে আলাদা করে তাকাতে হলে সেই নামটি নিঃসন্দেহে মাতঙ্গিনী হাজরা। এক অদম্য সাহসিনী, এক অবিচল অন্তর, এক স্নেহময়ী মাটি-মেয়ে—যাঁর জীবনযুদ্ধে প্রতিটি ধাপই ছিল সংগ্রামের, অথচ প্রতিটি পায়ে ছিল অসীম দৃঢ়তার আলো।

১৮৭০ সালের ১৭ নভেম্বর মেদিনীপুর জেলার ছোট্ট হোগল গ্রামে জন্ম হয় মাতঙ্গিনীর। পিতা ঠাকুরদাস মাইতি, স্বামী ত্রিলোচন হাজরা—শৈশব থেকে বৈবাহিক জীবন, কোনও পর্যায়েই সুখ তার কপালে বিশেষ জুটেনি। অল্প বয়সে বিয়ে, আবার অল্প বয়সেই বিধবা হওয়া—তার জীবনে যেন কেবলই ঝড়ের খেলা। তবুও ভাগ্যের আঘাতে ভেঙে পড়ার মানুষ ছিলেন না তিনি। পিতৃগৃহে ফিরে এলেও জীবনের প্রতি তাঁর কঠিন লড়াই শুরু হয়ে যায় সেখান থেকেই—অবিচল সাধনা, নিঃস্বার্থ সেবা আর দেশমাতৃকার প্রতি অটল ভালোবাসার পথ।
১৯৩২ সালের ২৬ জানুয়ারি স্থানীয় কংগ্রেস কর্মীরা পতাকা উত্তোলনের পর শোভাযাত্রায় বের হলে মাতঙ্গিনী বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে তাদের সঙ্গী হন। আলিনাম লবণকেন্দ্রে লবণ প্রস্তুত করে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। পুলিশ তাকে বহু দূর পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল, তবুও তিনি পিছু হটেননি। পরে চৌকিদারি ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলনে অংশ নিয়ে “গভর্নর ফিরে যাও” ধ্বনি তুলতেই তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ডে বহরমপুর জেলে বন্দী থাকতে হয়। কিন্তু কারাবাসও তাঁর মনোবল ভাঙতে পারেনি; বরং আরও শাণিত করেছিল তাঁর আন্দোলনের পথ।
১৯৩৩ সালে তমলুক মহকুমা কংগ্রেস সম্মেলনে ও ১৯৩৯ সালে মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেস মহিলা সম্মেলনে প্রতিনিধিরূপে উপস্থিত থেকে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন—বয়স নয়, আদর্শই মানুষের শক্তি। রোগ-বালাইয়ের সময় তিনি গ্রাম থেকে গ্রাম ছুটে বেড়াতেন সেবার অদম্য ইচ্ছায়। কলেরা, বসন্ত—যে দুর্যোগই আসুক, তিনি ছিলেন মানুষের পাশে। আর এই অকৃত্রিম মানবসেবার কারণেই স্থানীয় গ্রামের লোকেরা ভালোবেসে তাঁকে ডাকতেন—গান্ধীবুড়ি।
তারপর এল ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের আগুনঝরা সময়। মাতঙ্গিনী হাজরা হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে এক বিশাল সেচ্ছাসেবক বাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে দিতে থানা দখল অভিযানের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যান। ব্রিটিশ সৈন্যরা বর্বরতার পরিচয় দিয়ে গুলি চালাতে শুরু করলে সেচ্ছাসেবকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিন্তু মাতঙ্গিনী? তিনি থামেননি। জাতীয় পতাকাটি দুই হাতে উঁচিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন অটল বিশ্বাসে, অদম্য মনোবলে। তখনই প্রথম তাঁর হাতে গুলি লাগে… তবুও পতাকা পড়তে দেননি। শেষ গুলিটি লাগে তাঁর কপালে—আর পতাকা উঁচিয়ে ধরেই তিনি লুটিয়ে পড়েন মাটিতে।
সেদিন ২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪২—মেদিনীপুরের মাটি হারাল তার অগ্নিকন্যাকে। কিন্তু হারাল কি সত্যিই? বরং তাঁর মৃত্যু জন্ম দিল এক অগ্নিময় স্পন্দন, যা ছড়িয়ে পড়ল স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতিটি প্রান্তে। ইংরেজের নির্মমতা, দালাল পুলিশের নিষ্ঠুর আচরণ সেদিন প্রমাণ করেছিল তাদের বিবেক কতটা অন্ধকারে ঢেকে গেছে। কিন্তু মাতঙ্গিনীর পতাকা-ধরা হাত দেখিয়ে দিল—এক বৃদ্ধার শরীরে থাকলেও তাঁর মন ছিল অজেয়।
মাতঙ্গিনী হাজরা শুধু একটি নাম নয়; তিনি আমাদের জাতীয় গর্ব, আমাদের সাহসের আলো, আমাদের অগ্নিস্মৃতি। তাঁর আত্মোৎসর্গের আগুন আজও তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে স্বাধীনতার নতুন অর্থ শেখায়। তিনি যেন বলে যান—দেশকে ভালোবাসো, মানুষের জন্য বাঁচো, সত্যের সামনে মাথা নত কোরো না কখনো।
লেখায় : প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ