বিপ্লবের বাগ্মী বজ্রকণ্ঠ: বিপিনচন্দ্র পাল

১৮৫৮ সালের ৭ নভেম্বর, সিলেট জেলার হবিগঞ্জের পইল গ্রামে এক শিশুর জন্ম হয়েছিল—যিনি পরবর্তী কালে হয়ে উঠবেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক জ্বলন্ত প্রতীক। তিনি শুধু রাজনীতিক নন, ছিলেন এক প্রজ্বলিত বুদ্ধিজীবী, নির্ভীক সাংবাদিক, এবং তেজস্বী বাগ্মী। তার বক্তৃতার অগ্নিশিখায় তরুণরা আন্দোলিত হত, দেশের মাটিতে জেগে উঠত স্বাধীনতার ডাক। তিনি ছিলেন লাল-বাল-পাল ত্রয়ীর অন্যতম সেই বাঙালি বীর—বিপিনচন্দ্র পাল

সিলেটের এক উদার পরিবারে বড় হয়ে ওঠা বিপিনচন্দ্রের মনে শৈশব থেকেই মানবতা ও সাম্যের বীজ বপন হয়েছিল। তার পিতা রামচন্দ্র পাল ছিলেন জমিদার ও আইনজীবী, আর মাতা ছিলেন স্নেহশীলা ও উদারমনা। পারিবারিক সেই শিক্ষাই তাকে পরবর্তীতে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত করে।
সিলেট সরকারি বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন, যদিও স্নাতক শেষ করার আগেই পড়াশোনা ছেড়ে দেন। শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করে পরে তিনি কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক ও লাইব্রেরিয়ান হন। এই সময়েই তিনি কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মতো মনীষীদের সংস্পর্শে এসে ব্রাহ্ম আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
রাজনীতির অঙ্গনে তার পদার্পণ ঘটে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর প্রভাবে। পরে বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায় ও অরবিন্দ ঘোষের সাহচর্যে তিনি চরমপন্থী ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত হন। যদিও তিলকের হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে তার মতের অমিল ছিল, তবুও স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন।
১৯০৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন বন্দেমাতরম পত্রিকা, যা ব্রিটিশবিরোধী চেতনার আগুন ছড়িয়ে দেয়। ১৯০৮ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে সম্পাদনা করেন স্বরাজ পত্রিকা। কিন্তু ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।
বিপিনচন্দ্র পাল জীবনের শেষভাগে ধর্মচর্চায় মন দেন। ১৮৯৫ সালে বৈষ্ণব সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তিনি আধ্যাত্মিকতার পথে অগ্রসর হন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন চিন্তা, বিশ্বাস ও কর্মের এক দুর্নিবার শক্তি।
১৯৩২ সালের ২০ মে, এই দেশপ্রেমিক, চিন্তাবিদ ও বাগ্মী বিপ্লবীর জীবনাবসান ঘটে। কিন্তু ইতিহাস আজও তার কণ্ঠের আগুনে, তার কলমের দীপ্তিতে, তার চিন্তার স্বাধীনতায় খুঁজে ফেরে—বিপিনচন্দ্র পাল।
— লেখায় : প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ