ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের জীবন যেন এক জ্বলন্ত প্রদীপ—দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য নিজেদের পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করে দিয়েছেন। ছাত্রাবস্থাতেই যিনি বইয়ের পাতার বদলে হাতে তুলে নিয়েছিলেন বিপ্লবের মশাল, যিনি নিজের ভাগ্যে লিখে নিয়েছিলেন ত্যাগের কঠিন পথ—তেমনই এক দুর্বার বিপ্লবীর নাম শচীন্দ্রনাথ বক্সী। জন্ম তাঁর ১৯০৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর উত্তর প্রদেশের বারাণসীতে, তবে শিকড় ছিল বাংলার ফরিদপুরে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত, সংবেদনশীল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে গড়ে উঠছিল প্রতিবাদের আগুন। সেই আগুনই পরবর্তীতে তাঁকে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন—অর্থাৎ পরবর্তীতে হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
![]() |
| শচীন্দ্রনাথ বক্সী |
শচীন্দ্রনাথ বক্সী পড়াশোনার নিয়মিত পথে হাঁটেননি। বিপ্লবের রাস্তাই তাঁকে ডেকেছিল আরও বড় দায়িত্বের দিকে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাও দিতে পারেননি, কারণ ইতিমধ্যেই তাঁর তরুণ মন জড়িয়ে পড়েছে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে। তাঁর নাম ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ১৯২৫ সালের ৯ আগস্ট—কাকোরি ট্রেন ডাকাতির ঘটনায়। এই ঘটনার লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারের ধনসম্পদ লুট করে বিপ্লবীদের সংগ্রামের খরচ জোগানো, কিন্তু এর পেছনে ছিল আরও বড় বার্তা—ইংরেজদের বুক কাঁপিয়ে দেওয়া সাহসের প্রদর্শন।
কাকোরির সেই ঐতিহাসিক অভিযানের দু’মাস পর শচীন্দ্রনাথকে আটক করে পাঠানো হয় লখনউ সেন্ট্রাল জেলের ১১ নম্বর ব্যারাকে। ১৯২৭ সালের ১৩ জুলাই রায় ঘোষিত হয়—আন্দামানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সেলুলার জেলের সেই অন্ধকার সেলগুলোতে দিন কাটত শৃঙ্খল, যন্ত্রণা আর তবুও মাথা উঁচু করে থাকা এক তেজস্বী মন নিয়ে। কিন্তু এই বন্দিদশাও তাঁকে ভাঙতে পারেনি। তাঁর ভিতরের বিপ্লবী আরো দৃঢ় হয়ে ওঠে, আরো অগ্নিগর্ভ।
দীর্ঘ বারো বছরের কঠিন বন্দিজীবনের পর ১৯৩৭ সালে মুক্তি পান শচীন্দ্রনাথ বক্সী। এরপর তিনি যোগ দেন কংগ্রেসে। কিন্তু স্বাধীনতার পর যখন রাজনৈতিক পরিবেশ বদলে গেল, তখনও তাঁর অবস্থান ছিল সৎ, নির্ভীক ও আপসহীন। সাধারণ জীবনযাপন সত্ত্বেও তিনি মানুষের পাশে থেকেছেন। কংগ্রেস শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জনসঙ্ঘের প্রার্থী হিসেবে উত্তর প্রদেশ বিধানসভার সদস্যও নির্বাচিত হন তিনি—প্রমাণ করে দেন, বিপ্লবী আদর্শ কখনোই বদলায় না, শুধু পথ বদলায়।
২৩ নভেম্বর ১৯৮৪—এই দিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শচীন্দ্রনাথ বক্সী। কিন্তু চলে গেলেও রয়ে গেছে তাঁর সাহস, তাঁর সহজ-সরল মিষ্টি চরিত্র, আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করা সেই প্রতিবাদী মন। কাকোরির আগুন আজও যেন স্মরণ করিয়ে দেয়—স্বাধীনতা কোনো দান নয়, তা অর্জন করতে হয় সাহস, ত্যাগ আর অদম্য বিশ্বাস দিয়ে।
— লেখায়: প্রকাশ রায়

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন