ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বহু নাম আজ হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। এমনই এক নাম, যাঁর জীবন ছিল অভিযানে, বিপ্লবে, আদর্শে ও ত্যাগে পূর্ণ — তিনি হলেন বিপ্লবী অবনীনাথ মুখোপাধ্যায়।
অবনীনাথ মুখোপাধ্যায় মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর শহরে ১৮৯১ সালের ৩ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের খুলনায়। তিনি ছিলেন ভারতীয় ব্রিটিশবিরোধী একজন সাম্যবাদী, দূরদর্শী বিপ্লবী। ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন এই বীর। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের কুখ্যাত কার্লাইল ফতোয়া জারি হলে ছাত্র আন্দোলন নিষিদ্ধ হয়, আর তারই প্রতিবাদে কিশোর অবনীনাথ যোগ দেন এক জনসভায়। সেই অপরাধে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে শাস্তি দেয়, কিন্তু অবনী থামেননি—স্কুল ছেড়ে জামালপুরের রেল শ্রমিক ধর্মঘটে সামিল হন।
অল্প বয়সেই প্রবীণ সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ সখারাম গনেশ দেউস্করের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য পিতা তাঁকে আমেদাবাদের টেক্সটাইল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাঠান। কিন্তু ভাগ্য যেন লিখে রেখেছিল অন্য কিছু। ১৯১৪ সালে মহান বিপ্লবী বাঘা যতীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বাঘা যতীনের পরামর্শেই চাকরির অজুহাতে জাপানে যাত্রা করেন অবনীনাথ, উদ্দেশ্য — এশিয়ার সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। টোকিওতে দেখা হয় চীনের বিপ্লবনেতা সান ইয়াত-সেনের সঙ্গে, এবং তিনিই রাসবিহারী বসুর সঙ্গে ওয়েসির পরিচয় করিয়ে দেন।
জাপানে অবনীনাথ, ভগবান সিং ও রাসবিহারী বসুকে নিয়ে গঠন করেন অস্থায়ী বিপ্লব কমিটি। কিন্তু জার্মান দূতের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ফেরার পথে বিপ্লবীদের তথ্যভর্তি নোটবইসহ তিনি ধরা পড়েন পেনাং পুলিশের হাতে। ১৯১৭ সালে সিঙ্গাপুরে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়। সেখান থেকে জার্মান যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে এক অভূতপূর্ব পলায়ন ঘটিয়ে তিনি পালিয়ে যান। সুমাত্রায় এক রাবার বাগানে কাজ নেন, গোপনে ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতে, সেখানেই অবনীনাথ প্রথম রুশ বিপ্লবের খবর পান ও সমাজতান্ত্রিক দর্শনে আকৃষ্ট হন। এরপর শাহির ছদ্মনামে হল্যান্ড ও জার্মানিতে গমন করেন।
জার্মানিতে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বীরেন চট্টোপাধ্যায় ও মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল—বিদেশে অবস্থান করে এক নতুন বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলা, যেখানে জাতীয়তাবাদী ও কমিউনিস্ট সকল ভারতীয় একত্রিত হবেন। কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তাঁর খোঁজ পেয়ে যায়। রাশিয়া সরকারের কাছে তাঁকে প্রত্যর্পণের দাবিও জানানো হয়।
অবশেষে ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর, তাসখন্দে ৮ জন সদস্যকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি—যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অবনীনাথ ও তাঁর রুশ স্ত্রী রোজা ফিটিংগফ। তাঁরা ১৯২০ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীকালে অবনীনাথ তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে মেক্সিকো কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন।
১৯২২ সালে রাশিয়ার দুর্ভিক্ষ ত্রাণে ভারতীয় সমিতির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন, এবং ভারতের স্বাধীনতা বিষয়ে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাও করেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও বছর শেষে সাহস করে ভারতে ফিরে আসেন তিনি। মাদ্রাজে শ্রমিক নেতা সিংগারাভেলু চেট্টিয়ার ও কলকাতায় বিপ্লবী সন্তোষ কুমার মিত্র ও আবদুর রেজ্জাক খানের সঙ্গে দেখা করেন। তবে বিপ্লবী নলিনী গুপ্তের সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়ে কিছু বিতর্কের মুখেও পড়েন।
অবনীনাথ দেশীয় বিপ্লবীদের জন্য জার্মান অস্ত্র আনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি। দেশত্যাগের আগে ১৯২৪ সালের ২ মার্চ মাদ্রাজে প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দুস্থান শ্রমিক ও কৃষক পার্টি। পরবর্তীকালে মস্কোয় অধ্যাপনা করেন, হন সোভিয়েত প্রাচ্যতত্ত্ববিদদের সংস্থার সভাপতি ও কমিউনিস্ট একাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর সদস্য।
তাঁর রচিত গ্রন্থ India in Transition এম. এন. রায়ের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশিত হয়। এছাড়া গরীবের কথা (১৯২৩) এবং মোপলা বিদ্রোহ সম্বন্ধে পুস্তিকা—যা লেনিনের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ছিল—এই দুটি তাঁর অমর কীর্তি। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রবাসী পত্রিকায় লেখেন, অবনীনাথ ভারতের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করে মস্কো থেকে পিএইচডি লাভ করেছিলেন।
পরিবার জীবনে রোজা ও তাঁদের সন্তানদের নিয়েও ছিল এক করুণ অধ্যায়। পুত্র গোরা স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে মারা যান ১৯৪০ সালে, কন্যা মায়া রাশিয়ায় থেকেই সমাজসেবায় যুক্ত হন।
অবনীনাথ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু আজও রহস্যে ঢাকা। অনেকে বলেন, বুখারিনের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা এনকেভিডির হাতে তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন। ইতিহাসে তাঁর মৃত্যুর তারিখ ধরা হয় ১৯৩৭ সালের ২৮ অক্টোবর।
তিনি হয়তো ভুলে গেছেন সময়, কিন্তু তাঁর বিপ্লবী চেতনা, দেশপ্রেম আর আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি সেই মানুষ, যিনি ভাবতেন শুধু ভারতের নয় — গোটা বিশ্বের মুক্তির কথা। তিনি সত্যিই ছিলেন বিস্মৃতির অগ্নিশিখা, বিপ্লবী অবনীনাথ মুখোপাধ্যায়।
- লেখায়: প্রকাশ রায়


0 মন্তব্যসমূহ