অগ্নিনারী নেলী সেনগুপ্তা: বিপ্লব ও মানবতার প্রতীক

এক অনন্য সাহসিনী, যিনি শুধু রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজকর্মীই নন, ছিলেন এক নির্ভীক দেশপ্রেমিকা। পরাধীন ভারতের মাটিতে নারী শক্তির এক উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন অক্লান্তভাবে। নেলী সেনগুপ্তা ১৮৮৬ সালের ১২ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ফ্রেডারিক গ্রে ও মাতা এডিথ হেনরিয়েটা গ্রে। বিবাহসূত্রে তিনি যুক্ত হন ভারতীয় বিপ্লবী পরিবারে—দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের সাথে। স্বামীর আদর্শ ও দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করেন এবং হয়ে ওঠেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অমর নাম — নেলী সেনগুপ্তা।
১৯১০ সালে কলকাতায় কংগ্রেস রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে চট্টগ্রামে খদ্দর বিক্রির সময় প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তবুও তার পদক্ষেপ থেমে থাকেনি। ১৯৩০ সালে দ্বিতীয় অসহযোগ আন্দোলনের কাজে স্বামী যতীন্দ্রমোহনের সঙ্গে দিল্লি ও অমৃতসরসহ বহু স্থানে ঘুরে বেড়ান। দিল্লিতে এক সভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় পুনরায় গ্রেফতার হন। ১৯৩৩ সালের ২৩ জুলাই তার স্বামী, কংগ্রেস নেতা ও বিপ্লবী আন্দোলনের অকৃত্রিম বন্ধু ব্যারিস্টার যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যু নেলীকে ভেঙে দিতে পারেনি; বরং আরও দৃঢ় সংকল্পে তিনি স্বাধীনতার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেন।
দেশ ভাগের পরও তিনি পূর্ববঙ্গে থেকে যান এবং সেখানেই স্বামীর আদর্শে সমাজ ও রাজনীতির জন্য কাজ করে যান। ১৯৪৫ সালে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। পরবর্তীকালে ভূপতি মজুমদারের সঙ্গে একত্রে দেশ ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ চালিয়ে যান। তার অনবদ্য অবদান ও ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালে ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করে। কলকাতার লিন্ডসে স্ট্রিটের নাম আজ ‘নেলী সেনগুপ্তা সরণী’ — যা তার স্মৃতিকে চিরঅম্লান করে রেখেছে। এছাড়াও কেষ্টপুরে তার নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে।
১৯৭০ সালে অসুস্থ হয়ে তিনি চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আসেন। অবশেষে ১৯৭৩ সালের ২৩ অক্টোবর এই মহান দেশনায়িকা চিরনিদ্রায় শায়িত হন। তার জীবন যেন এক প্রদীপ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্বালিয়ে রাখবে দেশপ্রেমের আলো।
— লেখায়: প্রকাশ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ